ঐতরেয় আরণ্যক: প্রাচীনতম সাহিত্যিক সুত্র
ঐতরেয় আরণ্যক, ঋগ্বেদের অন্তর্গত। শুরুতে এর কোনো লিখিত রূপ ছিল না। গুরু থেকে শিষ্যের কাছে মৌখিকভাবে এ শিক্ষা পৌছে দেয়া হত। ঋষিদের কাছে যা ছিল অত্যন্ত পবিত্র। বলা হয় এর প্রতিটি পঙক্তি সম্পর্কে ঋষিরা শ্রুত অথবা দৃষ্ট হয়েছেন। তাই ঋগ্বেদ শ্রুতি সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত। ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব- চারটি বেদের মধ্যে প্রথমটি ঋগ্বেদ। বেদের প্রাথমিক পাঠ বা সংকলনকে সংহিতা বলে। প্রতিটি সংহিতার সাথে যুক্ত থাকে একটি ব্রাহ্মণ। এতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের নির্দেশনা থাকে। প্রতিটি ব্রাহ্মণে একটি করে আরণ্যক ও উপনিষদ থাকে। ঐতরেয় আরণ্যক- এ ‘বঙ্গ’ নামের উল্লেখ রয়েছে। যা এখন পর্যন্ত ‘বঙ্গ’ নামের সবচেয়ে প্রাচীন উৎস।
যার শিক্ষা অরণ্যে পালনীয় তাই ‘ঐতরেয় আরণ্যক’। ধারণা করা হয়, খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। অরণ্যবাসী ঋষি, মুনিদের জন্য এর অনুশাসন। সংস্কৃত ‘শ্রুতি’ ও ‘স্মৃতি’ সাহিত্যের সাথে এর সম্পর্ক রয়েছে। ‘স্মৃতি’ সংস্কৃত শব্দ; যার মূল হচ্ছে স্মর, অর্থাৎ স্মৃতিচারণ। তবে পুরাণ অনুযায়ী, ‘স্মৃতি’ হচ্ছে দেবতা ধর্ম ও মেধা’র মেয়ে। স্মৃতি; নির্দিষ্ট লিপিকর দ্বারা রচিত। স্মৃতিকে সাধারণত মৌলিক কাজ হিসেবে ধরা হয় না। শ্রুতি সাহিত্যের তুলনায় কম নির্ভরযোগ্য বলে মনে করা হয়।
‘বয়াংসি’ বা ‘পক্ষীবিশেষ’
ঐতরেয় আরণ্যক- শ্রুতি সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত। যা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম সাহিত্যিক সুত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর দ্বিতীয় খণ্ডে উল্লেখ করা হয়েছে; ‘বয়াংসি বঙ্গাবগাধাশ্চেরপাদ’। অর্থাৎ বঙ্গের লোকজন ‘বয়াংসি’ বা ‘পক্ষীবিশেষ’, পাখির মতো। এরা পাখির মতো কিচিরমিচির করে কথা বলে। এ প্রসঙ্গে অবশ্য ভিন্ন ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, কেন ঐতরেয় আরণ্যকের মতো ধর্মানুশাসন গ্রন্থে ‘বঙ্গ’ নামের উল্লেখ করা হলো? ‘বঙ্গ’ সম্পর্কে সেখানে কি লেখা রয়েছে? তাহলে, ঐতরেয় আরণ্যক- এর সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেয়া যাক।
অরণ্যে পালনীয় শিক্ষা
এখানে প্রথম তিনটি শ্লোকের ব্যাখ্যা লক্ষণীয়। অধ্যাপক আর্থার কিথ ও ফ্রিডরিখ ম্যাক্সমুলার প্রায় একই রকম ভাষান্তর করেছেন।
ক. এটাই একমাত্র পথ। এই আত্মত্যাগ এবং এই ব্রহ্ম। এটাই সত্য।
খ. কোন মানুষ যেন তা থেকে বিপথগামী না হয়। কোন মানুষ যেন এর সীমা অতিক্রম না করে।
গ. তাদের জন্য যারা কখনো এর সীমা অতিক্রম করেনি। প্রাচীনকালের সেই জ্ঞানী বৃদ্ধেরা এবং যারা এর সীমা অতিক্রম করেছিলো। তারা পথভ্রষ্ট হয়েছিলো।
তবে পরবর্তী অংশ দুটিতে তাদের বিরোধ সুস্পষ্ট।
ঘ. একজন ঋষি উল্লেখ করেছিলো যে – তিন শ্রেণীর মানুষ ছিলো সীমা লংঘনকারী। অন্যরা অনাবৃত আগুনের চারপাশে বৃত্তাকারে ঘিরে বসেছিলো। সূর্য তখন মধ্যগগনে। বায়ুপ্রবাহিত হয়েছিলো পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত।
ঙ. যখন তিনি বললেন, “যে তিন শ্রেণীর মানুষ সীমা অতিক্রম করেছিলো, তাদেরকেই আজ গাছ, লতাপাতা, সাপ ও পাখির রুপে দেখা যায়।
সুপ্রাচীন শ্লোক: নানা মুনির নানা মত
ম্যক্সমুলার এবং আর্থার কিথ উভয়েই দ্বিতীয় আরেকটি ব্যাখ্যা সমর্থন করেন। তিন শ্রেণীর মানুষ নরকের আগুনে জ্বলবে। চতুর্থ শ্রেণী; বিশ্বাসে পরিপূর্ণ এবং মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ শিখরে পৌছাঁতে বায়ু, অগ্নি ও অনান্য দেবতার পূজা করে। একই অংশের ব্যাখ্যায় আর্থার কিথ ভিন্ন বক্তব্য উপস্থাপন করছেন। তিনি ‘বয়াংসি বঙ্গাবগাধাশ্চেরপাদ’ ব্যাখ্যা করেছেন– তিন শ্রেণীর মানুষ ছিলো সীমা লংঘনকারী। যারা পাখির মত: বঙ্গ, বগাধ্, চেরাপাদ। তিনি ধারণা করেছেন এই ‘বঙ্গ’ আসলে বর্তমান বাংলাদেশের অংশ। ‘বগধ্’ হচ্ছে প্রাচীন ভারতের ‘মগধ’ জনপদ এবং ‘চেরাপাদ’ এর সাথে দক্ষিণ ভারতের ‘চেরাস্’ জাতির যথেষ্ঠ মিল রয়েছে।
অনার্য জাতি
‘বঙ্গ’ জনপদের মানুষের নিজস্ব ভাষা ও সাংস্কৃতিক পরিচয়টি বহু পুরনো। ‘বয়াংসি’ বা ‘পাখির মতো’ বলতে- অরণ্যবাসী মানুষকে বোঝানো হয়েছে। যাদের ভাষা আর্য ঋষিদের ভাষা থেকে ভিন্ন। তাই তাছিল্য করে ‘পাখির কিচিরমিচির’ অর্থে ‘বয়াংসি’ ব্যবহার করা হয়েছে। এই অনার্য মানুষেরা আগুনকে ঘিরে বসতে অস্বীকার করেছিলো। তাই তাদের কথা খুব সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করা হয়েছে। আর্যভাষী ঋষিদের সাথে অরণ্যবাসী অনার্য মানুষের প্রাথমিক সাক্ষাৎটি যজ্ঞ কেন্দ্রিক। বলি রাজার উপাখ্যান থেকেও এমন তাচ্ছিল্যের উদাহরণ পাওয়া যায়। রাজা হরিশচন্দ্রের উপাখ্যানটিও স্মরনীয়।
এক্ষেত্রে ‘জুয়াড়ির গান’ লেখাটিও প্রাসঙ্গিক।
ঐতরেয় আরণ্যক by নির্ঝর মাহমুদ is licensed under CC BY-NC-SA 4.0
1 Comment
[…] […]
Comments are closed for this article!