যেখানেই মানুষের পদচিহ্ন পড়েছে সেখান থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের গল্প পাওয়া যায়। এসব গল্প মূলত মানুষেরই গল্প। বলা হয়, প্রত্যেক মানুষই কিছু না কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করে থাকে। তার নিজের সাথে অবিচ্ছেদ্য এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টায় মত্ত থাকে।

সেইসব গল্প থাকছে ‘টুকরো গল্প’ পাতায়। 

বুদ্ধের পিঠে শহর
ছবি: ‍Sin News থেকে সংগৃহীত

শহরের বোঝা

সেচোয়ান প্রদেশের, ‘নানন’ নামক জেলায় প্রায় ৯ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট বিশালাকৃতিরে একটি বুদ্ধ মূর্তি পাওয়া গেছে। দেখে মনে হয় শাক্যমুনি তার নিজের কাঁধে সমগ্র শহরের বোঝা নিয়ে বসে আছেন। বহুতল ভবনের দেয়ালের সংস্কারের সময় বুদ্ধ মূর্তিটি পাওয়া যায়। মূর্তিটির ওপরেই সম্পূর্ণ আবাসিক ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে।

মূর্তিটি ‘কিং’ সাম্রাজ্যের সময় এটি নির্মিত বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে ‘নানন’ জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিভাগের বিশেষজ্ঞরা ভাস্কর্যটি এখনো অধ্যয়ন করছেন। এটি সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে তারা সনে করছেন। স্থানীয়দের সাথে আলাপ করে জানা যায় যে এখানে ভবন নির্মাণের পূর্বে একটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল। বুদ্ধ মূর্তিটি মাথাবিহীন। ভবনটির আশেপাশে খুঁজে তা এখনো পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের অনুমান এর বয়স হাজার বছরেরও বেশী। তবে এখনো জানা যায়নি তা কত পুরনো।

সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র

২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের সোমবারের কথা। চমৎকার আবহাওয়ার কারণে, হ্যানসন নামক নিলামকারী প্রতিষ্ঠানের সবাই বেশ উৎফুল্ল। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মার্টিন পেশায় একজন সংগ্রাহক। প্রাচীন জিনিসপত্র, শিল্পকর্মের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থেকে প্রায় সাত বছর ধরে সে একই পেশায় কাজ করছে। ডার্বির ধনী ব্যবসায়ীদের শখের জিনিসপত্র, সংগ্রহ নিয়ে এবারের নিলাম অনুষ্ঠান; তাই সে বেশ আগ্রহী। অনান্য দিনের মতো মার্টিন, হ্যানসনের পুরাকীর্তি বিশেষজ্ঞ জেমস ব্রেঞ্চলির সাথে কাজ করছিল। পুরাকীর্তি বোঝাই ভ্যান থেকে কিছু মৃৎপাত্র আলাদা করার সময় সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। মৃৎপাত্রের গায়ে আঁকা ছবির সাথে; তার নিজের সংগ্রহে থাকা একটি ছোট্ট মাটির পাত্রের সাদৃশ্য আছে কিনা তাই বসে ভাবতে থাকে। বছর খানেক আগে, আরো বেশ কিছু মাটির পাত্রের সাথে মাত্র ৪ ইউরোতে যা সে কিনেছিলো। মৃৎপাত্রটি দেখামাত্রই তার পছন্দ হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত, সে পাত্রটিকে টুথব্রাশ রাখার কাজে ব্যবহার করে আসছিল।

সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র
Indus Valley Pottery By Hansons Actioneers
সাকাশ্বর স্তম্ভ। ছবি: শ্যাম বর্ণ, মৃত্তিকা।

সাকাশ্বর স্তম্ভ

সাকাশ্বর স্তম্ভ নিয়ে আমরা যতটুকু জানি তার থেকে না জানা প্রশ্নের সংখ্যাই বেশী। স্তম্ভটি কোথা থেকে এলো? মানুষ সাকাশ্বর স্তম্ভের সাথে কী সম্পর্ক খুঁজে পায়? মাধব মন্দিরের সাথে এই সাকাশ্বর স্তম্ভের কী সম্পর্ক? সাকাশ্বর স্তম্ভের সাথে দৈববাণী বা প্রত্যাদেশের কী সম্পর্ক? সাকাশ্বর স্তম্ভকে অশোক স্তম্ভ বলার কারণ কী?

এ স্তম্ভকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে অজস্র গল্প। বর্তমানে স্তম্ভটি যে স্থানে আছে, পূর্বে তা অন্যকোথাও ছিল বলে জানা যায়। জনশ্রুতি আছে, কেউ একজন সাকাশ্বর স্তম্ভটি তুলে নদীতে ফেলে দেয়। তার কিছুদিন পর সে স্বপ্নে দেখতে পায় যে, যদি নদী থেকে স্তম্ভটি না উদ্ধার করা হয়, তাহলে তার ক্ষতি হবে। বহু লোকজন দিয়ে নদী থেকে তুলে স্তম্ভটি পুনস্থাপন করা হয়। সাকাশ্বর স্তম্ভের সাথে এই দৈববাণী বা প্রত্যাদেশের কী সম্পর্ক?

 

‘শিলুয়া’ ও দুর্বোধ্য লিপি

বাংলাদেশে খ্রিস্টপূর্ব যুগের মহাস্থানগড় শিলালিপির কথা আমরা সবাই জানি। তবে দুর্বোধ্য লিপি উৎকীর্ণ রয়েছে এমন আরো একটি মূর্তিলেখের কথা জানা যায়। মূর্তিটি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানায়, ‘শিলুয়া’ গ্রামে অবস্থিত। আজকের লেখা সেই শিলালিপি নিয়ে।

‘সিলওয়া’, ‘সিলুয়া’ অথবা ‘শিলুয়া’; বিভিন্ন সুত্রে তিনটি নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ১৯৫২ সালের দিকে জরিপ পরিচালনার সময় আ কা মো যাকারিয়া ‘সিলওয়া’ নামটি ব্যবহার করেন। দীনেশচন্দ্র সরকার তার ‘পাল-পূর্ব যুগের বংশানুচরিত’ গ্রন্থে ‘সিলুয়া’ নামটি উল্লেখ করেছেন। ‘শিলুয়া’ নামটি সাম্প্রতিক কালের। 

‘শিলুয়া’ ও দুর্বোধ্য লিপি
কুঁজো মহিষের উপাখ্যান
কুঁজো মহিষের ভাস্কর্য। নৃ

কুঁজো মহিষের উপাখ্যান

প্রায় ১১৭০০ বছর আগেকার কথা। তখন উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি থেকে ক্রমশ বরফের আচ্ছাদন সরে যাচ্ছে। উচুঁ প্যানিকাম ঘাসে ছেঁয়ে গেছে ‘ওয়ানাসকেউইন’ অঞ্চল। সবুজ ঘাসের লোভে কুঁজো মহিষের পাল এসে জড়ো হচ্ছে ‘ওপিমিহো’ জলধারার কাছে।

তাদের পিছুঁ নিয়েছে ধূসর রঙের শিকারী নেকড়ের দল। এরা একে অপরের সাথে লড়াই করে এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র টিকিয়ে রাখে। ধূসর নেকড়ের পাশাপাশি কয়েকদল শিকারী ও সংগ্রাহক গোষ্ঠী মহিষের পালকে অনুসরণ করতে থাকে। তাদের মধ্যে ‘ওজিবওয়ে’ ও ‘ক্রী’ জনগোষ্ঠী অন্যতম। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে ‘ওয়ানাসকেউইন হেরিটেজ পার্ক’ থেকে প্রায় ৬০০০ বছর আগে মানুষের বসতি স্থাপনের প্রমাণ মিলেছে।

পুকুনিয়া, উয়ারী-বটেশ্বর। ছবিসত্ত্ব: শ্যামবর্ণ, মৃত্তিকা।

উয়ারী-বটেশ্বর

প্রত্নতত্ত্ব পুরোনো জিনিস সম্পর্কে নতুন তথ্য সন্ধানের একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। প্রত্নতত্ত্ব; মানুষের ফেলে আসা বস্তুগত উপাদানগুলো অধ্যয়ন করার মাধ্যমে অতীত মানুষের আচরণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত এসব তথ্য থেকে অতীতকালের মানুষ সম্পর্কে পুরোপুরি জানা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত এসব তথ্য- সম্পূর্ণ একটি ফটোগ্রাফের এক টুকরো অংশের মতন। বাকি অংশগুলো খুঁজে পাবার আশায় প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অবিরাম চেষ্টা করতে থাকেন। উয়ারী-বটেশ্বর সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনেকটা একই রকম। উয়ারী-বটেশ্বর প্রায় আড়াই হাজার বছর পুরানো নগরসভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এটি খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে খুঁজে পাওয়া এসব তথ্য নিয়ে আমাদের টুকরো গল্প উয়ারী-বটেশ্বর।