আধুনিক বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব
যে কোন বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা অর্জনের ক্ষেত্রে, বিষয়বস্তুটির ধারাবাহিক ইতিহাসের কিছুটা গুরুত্ব থাকে। তবে প্রত্নচর্চার ক্ষেত্রে তা ভিন্নভাবে কাজ করে। প্রত্নতত্ত্ব সাধারণত; অনুসন্ধানে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে, খণ্ড খণ্ড আকারে মানুষের ইতিহাসকে উন্মোচন করে। তাই প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যের ভিত্তিতে নির্মিত; ধারাবাহিক ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সহনশীল মনোভাব সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আধুনিক বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে প্রত্নতত্ত্বের আবির্ভাবের ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ। তবে তার আগে বিশ শতকের দিনলিপি থেকে কিছু গল্প শোনা যাক।
বিশ শতকের দিনলিপি
১। বিশ শতকের শুরুতে; জার্মান ব্যবসায়ী হেনরিখ শ্লীমানের আবিস্কৃত (রাজা আগামেনন এর সোনার মুখোশ) মাইসেনিয়ান সভ্যতার প্রাচীনত্ব নিয়ে সবাই যখন সন্তুষ্ট, ঠিক সেই সময় আর্থার ইভানস মাইনোয়ান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন। ১৯০০ সালে আবিষ্কৃত এ সভ্যতা, মাইসেনিয়ান সভ্যতা থেকেও বহু প্রাচীন সভ্যতা।
২। ১৯১০ সালে ‘বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি’ গঠিত হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের অতীত ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করা ছিল এর মূল লক্ষ্য। প্রত্নবস্তু অনুসন্ধানের পাশাপাশি বরেন্দ্র যাদুঘর স্থাপনে এর ভূমিকা অনন্য। ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বরেন্দ্র যাদুঘরের দায়িত্ব গ্রহণ করে।
৩। লেনার্ড উলি ১৯১২ সালে সিরিয়াতে খননকার্য পরিচালনা করেন। এ সময় টি. ই. লরেন্স তাকে সহযোগিতা করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে টি. ই. লরেন্স (লরেন্স অব অ্যারাবিয়া) বৃটিশ সরকারের গুপ্তচরের ভূমিকা পালন করেন। সে সময় লেনার্ড উলি’র সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। বিশ্বযুদ্ধ শেষে, লেনার্ড উলি ইরাকের বেশ কিছু স্থানে খননকার্য পরিচালনা করেন। এর ফলে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা- মেসপটেমিয়া সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। তার খননকার্য থেকে প্রাচীন ‘উর’ নামক শহরটি পুনরায় তার অস্তিত্ব জানান দেয়। আত্মবিস্মৃত মানুষ, ৪৫০০ হাজার বছর পরে আবার তার অতীত সম্পর্কে অবগত হয়। লেনার্ড উলি এ আবিষ্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরে, দশ খণ্ডের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
৪। জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক লুডউইগ বোর্চার্ড ১৯১২ সালে মিশরে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। তিনি রাণী নেফারতিতির ভাস্কর্যটি শনাক্ত করেন। মিশরের সরকার বহুবার তা ফেরত পাঠানোর দাবি জানায়। বর্তমানে তা বার্লিন যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
৫। আরবি ভাষায় পারদর্শী; মার্গারেট বেল, ইরাকে বেশ কিছু অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। তার সংগৃহীত তথ্য, উপাত্ত ও পুরাকীর্তি পরবর্তীতে; ইরাক যাদুঘর তৈরীতে অসামান্য ভূমিকা পালন করে।
৬। ১৯২২ সালে হাওয়ার্ড কার্টার, রাজা তুতেনখামেন- এর সমাধিস্থল প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করেন। এ সমাধিস্থল থেকে মিশরীয়দের মৃত্যু ভাবনা, মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে মানুষ বিস্তারিত জানতে পারে।
৭। ১৯২২-১৯২৩ সালে রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় সিন্ধু সভ্যতার কথা বিশ্বের কাছে তুলে ধরেন। তিনি মহেঞ্জোদারো শহরটিতে অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। An Indian City Five Thousand Years Ago- এ সম্পর্কে তার বিখ্যাত প্রবন্ধ। তাছাড়া বাংলায় পাল রাজবংশ সম্পর্কিত বহু তথ্য তিনি আবিষ্কার করেন। তিনি পাহাড়পুরে খননকার্যের পরিচালক ছিলেন। মুদ্রা সম্পর্কে বাংলাতে প্রথম গ্রন্থ রচনা তার অন্যতম কৃতিত্ব। এছাড়াও কুষান সম্রাট কণিষ্ক সম্পর্কে তিনি যে সব তথ্য আবিষ্কার করেন তা প্রামান্য বলে বিবেচিত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য রচনা বাঙ্গালার ইতিহাস, শশাঙ্ক ও ধর্মপাল।
৮। বাংলাদেশের প্রাচীনতম শিলালিপি পাওয়া যায় বগুড়ার মহাস্থানগড়ে। ১৯৩১ সালে আংশিক খননেই শিলালিপিটি পাওয়া যায়। লিপিটি সম্পর্কে পণ্ডিতদের নানরকম অভিমত রয়েছে। তবে কতগুলো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে সহজেই ধারণা পাওয়া যায়। শিলালিপিটির পাথরের ধরণ, ক্ষুদ্র লাল গোলাকৃতি লাইমস্টোন বা চুনাপাথর। লিপিটি ব্রাহ্মী অক্ষরে খোদাইকৃত; বাম থেকে ডানে লেখা।
৯। ম্যাক্স ম্যালোয়ান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মেসপোটেমিয়া সভ্যতা নিয়ে বেশ কিছু অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। তার স্ত্রী আগাথা ক্রিস্টির এ বিষয়ে লেখা উপন্যাস ‘Come, Tell me How You live’- প্রত্নচর্চার ক্ষেত্রে অবশ্য পাঠ্য। মূলত আত্নজীবনীমূলক উপন্যাস হলেও, উপনিবেশিত রাষ্ট্রে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান কেমন হয় তার বিবরণ নিয়ে লেখা অসাধারণ একটি বই। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চলাকালে সিরিয়া ও ইরাকের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এমন প্রাণবন্ত বিবরণ অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
১০। পিট রিভার্সের পদ্ধতিকে আরো সমৃদ্ধ করেন মর্টিমার হুইলার। তিনি সিন্ধু সভ্যতা নিয়েও বেশ কিছু অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। তিনি ‘লন্ডন স্কুল অব আর্কিওলজি এর অনুকরণে ‘টেক্সিলা ট্রেনিং স্কুল অব আর্কিওলজি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
১১। ১৯৬৪ সালে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত অনুসন্ধান থেকে, ‘গোবেকলী তেপে’ নামটি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে জার্মান প্রত্নতাত্ত্বিক ক্লস শ্মিট পুনরায় অনুসন্ধান করেন। স্থানীয় মানুষ একে ‘গোবেকলী তেপে’ নাম দেয়, বাংলায় যার অর্থ পেট মোটা পাহাড়। ধারণা করা হয় উপাসনার জন্য স্থানটি ব্যবহৃত হত। স্থানটি নব্যপ্রস্তর যুগের, প্রাক-মৃৎশিল্প পর্যায়কালের।
১২। ১৯৭৪ সালে চীনের কৃষকেরা কূপ খননের সময় কতগুলো পোড়ামাটির মূর্তি আবিষ্কার করেন। তারা মাটির নীচে, সমাধির প্রশস্ত পথ দেখতে পান। পরবর্তীতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে জানা যায় এ সমাধি প্রায় ২০০০ বছর পুরোনো ‘চিন’ সাম্রাজ্যের সময়কালের। ২৪৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দে সম্রাট চিন শি ওয়াং- এর নির্দেশে এ সমাধি তৈরী হয়।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে- প্রত্নতত্ত্ব সাধারণত; অনুসন্ধানে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে, খণ্ড খণ্ড আকারে মানুষের ইতিহাসকে উন্মোচন করে। ধারাবাহিক ইতিহাস পাঠের ক্ষেত্রে তাই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। যেমন- ২০১৯ সালে প্রচণ্ড খরায়,তাইগ্রিস নদীর পানির উচ্চতা ভয়াবহ নেমে যায়। এসময় প্রত্নতাত্ত্বিকেরা, মিত্তানী সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পান। এর আগে মিত্তানী সাম্রাজ্য সম্পর্কে খুব বেশী ইতিহাস জানা যায় নি। মিশরের হায়রোগ্লিফ লিপি থেকে জানা যায় তারা হুরিয়ান ভাষায় কথা বলতো। এ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার তাই নতুন করে ইতিহাস নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। এখনো মিত্তানী সাম্রাজ্য নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চলছে।
প্রত্নচর্চায় বিভিন্ন পদ্ধতির ব্যবহার
কার্বন ডেটিং আবিষ্কার প্রত্নচর্চার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা হাজির করে। সাধারণত এই পদ্ধতিকে রেডিওকার্বন ডেটিং বা কার্বন-১৪ ডেটিং বলা হয়। কোন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানে উপস্থিত জৈব পদার্থের বয়স নির্ণয়ে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। ১৯৪০ সালে উইলার্ড লিবি এ পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। প্রত্নচর্চায় সর্বপ্রথম চৌম্বকীয় পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় ১৯৫৭ সালে। মাটির নীচে প্রত্নতাত্ত্বিক কাঠামো শনাক্তকরণে তা ব্যবহার করা হয়।
এডওয়ার্ড চার্লস হ্যারিস, প্রত্নতাত্ত্বিক খননের স্তরবিন্যাসকে উপস্থাপনের জন্য; ১৯৭৩ সালে একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। যা হ্যারিস ম্যাট্রিক্স (Harris Matrix) পদ্ধতি নামে বহুল পরিচিত। এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে; প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রাপ্ত বিভিন্ন স্তরের (Strata) মাঝে, স্তরবিন্যাসগত (Stratigraphic) সম্পর্ককে একটি ধারাবাহিক নকশার (Diagram) মাধ্যমে প্রকাশ করা।
১৯৮০ সালের দিকে প্রত্নচর্চায় GPR পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। GPR (Ground Penetrating Radar) পদ্ধতিতে তড়িতচৌম্বক তরঙ্গ প্রেরণ করে সংকেত ধারণ করা যায়। ভূত্বকের গভীরে বস্তুর অবস্থান, দূরত্ব, উচ্চতা নির্ণয়ে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তবে যান্ত্রিক ত্রুটির মান বেশী হওয়ায় তা প্রত্নতাত্ত্বিকদের মাঝে জনপ্রিয় হতে পারে নি।
বিশ শতকের শেষের দিকে প্রত্নচর্চায় আলোক রশ্মির সাহায্যে LIDAR (Light Detection and Ranging) পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়। এ পদ্ধতিতে বিক্ষিপ্ত আলো বিশ্লেষণ করে দূরত্ব পরিমাপ করা যায়। প্রত্নস্থল শনাক্তকরণ, পরিসীমা নির্ধারণে ও মানচিত্র তৈরীতে যা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
একুশ শতকে প্রত্নচর্চা
একুশ শতকে প্রত্নতত্ত্ব আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। গবেষণার ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব এড়ানোর জন্য; বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পাশাপাশি, ইতিহাসের বিবরণ ও সংস্কৃতি বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে একত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ শতকের শেষের দিকে প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইন পাশ হয় যা একুশ শতক থেকে কার্যকর হয়। নিত্যনতুন কৌশল ও সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির ব্যবহার; প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে এখন বেশ জনপ্রিয়। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান শেষে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো যাচাই বাছাই, পর্যবেক্ষণ ও তালিকাভুক্ত করার জন্য অত্যাধুনিক ‘প্রত্নতত্ত্ব গবেষণাগার’ এসময়ের উল্লেখযোগ্য অবদান। তাছাড়া Public Archaeology বা সর্বজনীন প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এসময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রায় এক শতাব্দীর প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ও জ্ঞানের সংমিশ্রণে; পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষের অতীতকালের গল্প আবার নতুন করে উপস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে।
(প্রত্নতত্ত্বের প্রথম পাঠ: ৩য় পর্বে সমাপ্ত)
তথ্যনির্দেশ
১। An Indian City Five Thousand Years Ago (Calcutta Municipal Gazette, November 1928)
২। A Complete Manual of Field Archaeology by Martha Joukowsky.
৩। Archaeology for Dummies by Nancy Marie White. Page: 15-17.
৪। অধ্যাপক নেল অ্যাসচারসনের সাক্ষাৎকার। https://fivebooks.com/best-books/best-books-archaeology-neal-ascherson/