বাংলাদেশে খ্রিস্টপূর্ব যুগের মহাস্থানগড় শিলালিপির কথা আমরা সবাই জানি। তবে দুর্বোধ্য লিপি উৎকীর্ণ রয়েছে এমন আরো একটি মূর্তিলেখের কথা জানা যায়। মূর্তিটি ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া থানায়, ‘শিলুয়া’ গ্রামে অবস্থিত। আজকের লেখা সেই শিলালিপি নিয়ে।
নামবিভ্রাট
‘সিলওয়া’, ‘সিলুয়া’ অথবা ‘শিলুয়া’; বিভিন্ন সুত্রে তিনটি নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ১৯৫২ সালের দিকে জরিপ পরিচালনার সময় আ কা মো যাকারিয়া ‘সিলওয়া’ নামটি ব্যবহার করেন। দীনেশচন্দ্র সরকার তার ‘পাল-পূর্ব যুগের বংশানুচরিত’ গ্রন্থে ‘সিলুয়া’ নামটি উল্লেখ করেছেন। ‘শিলুয়া’ নামটি সাম্প্রতিক কালের। আমরা এক্ষেত্রে ‘শিলুয়া’ নামটি ব্যবহার করছি। তবে বক্তব্যের ক্ষেত্রে, উল্লেখিত নামগুলো হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব বাংলা
প্রাচীন লিপি বিশারদ দীনেশচন্দ্র সরকার, তার ‘পাল-পূর্ব যুগের বংশানুচরিত’ গ্রন্থে বাংলাদেশে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব যুগের দুটি শিলালেখ এর কথা উল্লেখ করেছেন। একটি বগুড়া জেলায় প্রাপ্ত মহাস্থানগড় ব্রাহ্মীলিপি। অপরটি নোয়াখালিতে প্রাপ্ত ‘সিলুয়া’ মূর্তিলেখ। লেখকের ভাষায়-
‘বিশাল মূর্তিতে অভিলেখ অস্পষ্ট। আনুমানিকভাবে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর ব্রাহ্মীলিপিতে লিখিত’।
– দীনেশচন্দ্র সরকার
তিনি এখানে ১৯৩০-৩৪ সালের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপের বিবরণ ব্যবহার করেছেন।
তবে ‘শিলুয়া’ সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যাটি পাওয়া যায়, আ কা মো যাকারিয়া রচিত ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ গ্রন্থে। তিনি ছিলেন একাধারে প্রাচীন পুঁথি সংগ্রাহক, একজন বহুভাষাবিদ ও স্বশিক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক। তিনি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় কয়েক শ অমূল্য আর দুষ্প্রাপ্য প্রত্নসামগ্রী যোগাড় করেছিলেন।
১৯৬৮ নিজের সংগৃহীত দুষ্প্রাপ্য মূর্তি, মুদ্রা, শিলালিপিসহ সব প্রত্নসামগ্রী দান করেছিলেন দিনাজপুর জাদুঘরে। প্রত্নতত্ত্বের পড়াশোনায় পাঠ্যবই হিসেবে তার বইয়ের বিকল্প নেই।
‘এদেশের প্রাচীন কীর্তিগুলিকে আমি যতটুকু দেখেছি, ইতিহাসের আলোকে সেগুলিকে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, তা-ই এ গ্রন্থে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি’।
– আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া।
তার বক্তব্য অনুযায়ী-
‘ফেনী শহর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণে সিলওয়া নামক একটি অতি প্রাচীন স্থান আছে। এ গ্রামে একটি অনুচ্চ, সমতল ঢিবি আছে। ঢিবিটিতে কোনো প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ লুক্কায়িত আছে কিনা, তা উৎখনন না করে নিশ্চিত করে বলার মতো কোনো উপায় নেই। তবে ঢিবির উপরে যে, একটি মূর্তির ভগ্নাবশেষ আছে, তা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে’।
– আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া।
দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, সমতল ঢিবির চিহ্নটুকুও আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
‘শিলুয়া’ মূর্তির গঠন ও প্রকৃতি
আ কা মো যাকারিয়ার বিবরণ থেকে জানা যায় যে – সিলওয়া মূর্তিটি বেলেপাথরে নির্মিত। এর একটি স্তম্ভমূল (Pedestal) আছে। স্তম্ভমূলের উপরে মূর্তিটির পাদদেশের সামান্য অংশই বর্তমানে টিকে আছে। এ থেকে ধারণা করা যায় যে, এটি ছিল বিরাট আকারের (Colossal Type) মূর্তি।
দুর্বোধ্য শিলালিপি
দীনেশচন্দ্র সরকার, ‘শিলুয়া’ মূর্তিলেখটি ব্রাহ্মী অক্ষরে লিখিত বলে অনুমান করেছেন। তবে আ কা মো যাকারিয়ার ভাষায়-
‘মূর্তির স্তম্ভমূলে দুর্বোধ্য ভাষায় একটি ক্ষুদ্র লিপি খোদিত ছিল। সেই লিপির পাঠ কেউ উদ্ধার করতে পারেননি। বর্তমানকালে (১৯৫২ খ্রি:) কিছু অস্পষ্ট আঁচড় ছাড়া লিপির সব কিছু মুছে গেছে বলে সেই লিপির পাঠোদ্ধার করা আর কিছুতেই সম্ভব নয়’।
– আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া
বর্তমানে ‘শিলুয়া’র মূর্তিলেখটি প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী সংরক্ষিত রয়েছে ।
তথ্যসূত্র
পাল-পূর্ব যুগের বংশানুচরিত; দীনেশচন্দ্র সরকার, পৃষ্ঠা: ১৪-১৫।
Annual report of the Archaeological Survey of India (1930-34), Part I, page 38-39.
বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ; আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, পৃষ্ঠা: ৬৮২।
This work is licensed under a Creative Commons Attribution 4.0 International License.
No comment yet, add your voice below!