প্রত্নতত্ত্বের প্রথম পাঠ
প্রত্নতত্ত্ব আমাদের চারপাশের মানুষ ও তার আচরণ এবং অতীতকালের সাথে তার সম্পর্ক কেমন ছিলো; সেই ধারণাকে আরো অর্থবহ করে তোলে। আমরা যখন প্রাচীন কোনো সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষের মুখোমুখি হই কিংবা হাজার হাজার বছর আগে বেঁচে থাকা মানুষের ব্যবহার্য কোনো জিনিসের অবশেষ হাতে তুলে নেই, তখন মানুষের জীবনের অবিছিন্ন ধারাবাহিকতাকে উপলব্ধি করতে পারি। প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে যে প্রশ্নগুলো আমাদের ভাবায়- প্রত্নতত্ত্ব বলতে কী বোঝায়? অথবা প্রত্ন শব্দের অর্থ কী? কিংবা আধুনিক বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে প্রত্নতত্ত্বের আবির্ভাব কীভাবে হলো? প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের বিস্ময়কর সব আবিষ্কারের অজস্র গল্পের আড়ালে সে সব প্রশ্নের উত্তর একসময় চাপা পড়ে যায়। প্রাথমিক সেইসব বিষয়বস্তু; যা সম্পর্কে ধারণা থাকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ তাই নিয়ে আমাদের লেখা প্রত্নতত্ত্বের প্রথম পাঠ।
প্রত্নতত্ত্বের আবির্ভাব
যে কোন বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা অর্জনের ক্ষেত্রে, বিষয়বস্তুটির ধারাবাহিক ইতিহাসের কিছুটা গুরুত্ব থাকে। তবে প্রত্নচর্চার ক্ষেত্রে তা ভিন্নভাবে কাজ করে। প্রত্নতত্ত্ব সাধারণত অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে খণ্ড খণ্ড আকারে মানুষের ইতিহাসকে উন্মোচন করে। তবে প্রত্নতত্ত্ব আধুনিক বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে আবির্ভাবের পূর্বের ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ।
প্রথম খননকারী
স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে পুরোনো জিনিসের কদর করা মানুষের স্বভাব। প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ও ঐতিহাসিক নথিপত্রের মাঝে; প্রাচীন মিশর ও ব্যাবিলনের রাজাদের, নিজেদের গৌরবময় অতীত পুননির্মাণের আগ্রহের প্রমাণ পাওয়া যায়। মিশরের রাজা খীমায়া (রামসেস ২, চতুর্থ সন্তান); প্রাচীন মিশরের গৌরবময় অতীতের প্রতি প্রচন্ড কৌতুহল থেকে স্টেপ পিরামিডের অবশেষ শনাক্তকরণ ও পুননির্মাণ করেন। তাকে তাই প্রথম মিশরবিদ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
প্রথম খননকারীদের মধ্যে ব্যবিলনের রাজা নবোনিডাস (খ্রীস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দী) অন্যতম। তাকে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক খননের কৃতিত্ব দেয়া হলে ভুল বলা হবে না। তার খননকৃত মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তরটি প্রাচীন কোনো মন্দিরের বলে তিনি শনাক্ত করেন। তিনি চিহ্নিত করেন মন্দিরটি রাজা সারগনের পুত্র ‘নারাম-সিন’ এর তৈরী। প্রাচীন দেবতা ‘সিন’, ‘ইশতার’ ও ‘শামস্’ কে উৎসর্গ করে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিলো। তিনি সুমেরীয় মন্দির তথা পিরামিডের অবশেষ খনন, পুননির্মাণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন।
সতেরো-আঠারো-উনিশ শতকের দিনলিপি
আলোকময় যুগের বহুকাল আগে থেকেই মানুষের অতীতকাল নিয়ে আগ্রহ ছিল। তবে এ সময়ের মধ্যেই, অতীতকাল সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ ও আত্নপরিচয় নির্মাণের তথাকথিত ধারণাটি বিকশিত হতে থাকে। এই ধারণা, আঠারো শতক হতে উনিশ শতক পর্যন্ত বিভিন্নভাবে পুরাতাত্ত্বিক অনুসন্ধান, সংগ্রাহক ও লুটেরাদের অনুপ্রাণিত করেছে। বিখ্যাত মাঠ প্রত্নতাত্ত্বিক মার্থা জুকোস্কির মতে- “১৮৪০ সাল পর্যন্ত প্রত্নতত্ত্ব ধনী ও হঠকারী সংগ্রাহকদের শখের পেশা হিসেবে বিবেচিত হতো। অপেশাদার ইতিহাসবিদ, ভূতাত্ত্বিকদের কাছে তা ছিল যে কোন আকর্ষণীয় বস্তু সংগ্রহের প্রক্রিয়া মাত্র। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব প্রত্নবস্তু কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তার কোন লিখিত সুত্র বা উৎস পাওয়া যায় নি”।
প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসের ক্ষেত্রে এ ঘটনাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। ধারাবাহিক বিবরণ না দিয়ে শুধুমাত্র প্রাথমিক ধারণা নেয়ার উদ্দেশ্যে আমরা কতগুলো বিষয় আলোচনা করছি-
পুরাতাত্ত্বিক, পরিব্রাজক, সংগ্রাহক ও লুটেরা
সতেরো-আঠারো শতক জুড়ে ধনী পরিব্রাজক ও হঠকারী সংগ্রাহকদের শখ পুরণ হয়- মেসপোটেমিয়া ও মিশরের প্রাচীন শহরগুলো থেকে। লুটেরাদের সংগৃহীত অসংখ্য মূল্যবান প্রাচীন বস্তু, ভাস্কর্য থেকেই Antiquties বা পুরাকীর্তির চাহিদা বৃদ্ধি পায় সমগ্র ইউরোপজুড়ে। পুরাতাত্ত্বিকেরা (Antiquarian) তখন বিভিন্ন যুগের পুরাবস্তু, স্থাপনা ও ভাস্কর্য খুঁজে বেড়াতে শুরু করে। এর পাশাপাশি পরিব্রাজক, সংগ্রাহক ও লুটেরাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সে সময় প্রত্নবস্তু সংগ্রহের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। নিজস্ব গৌরবময় অতীত নির্মাণ- ধারণাটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
তবে এমন কিছু অনুসন্ধানের কথা বলা যায় যা পরবর্তীকালে, প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের বিভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রয়োজন তৈরী করেছিলো। এ সময়েরই উল্লেখযোগ্য ঘটনা- পম্পেই নগরী আবিষ্কার। ভিসুভিয়াসের আগ্নেয় ছাই থেকে পুনরায় মাথা তুলে, নিজ অস্তিত্বর কথা জানান দেয় বিখ্যাত পম্পেই নগরী। তাছাড়া রোমের বিভিন্ন স্থাপনার সন্ধান; প্রাগৈতিহাসিক স্টোনহেঞ্জ এর আবিষ্কার মানুষকে নতুন করে তার ইতিহাস নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
সংগৃহীত প্রত্নবস্তু দিয়ে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা ও প্রদর্শনী আয়োজন করার ঘটনাটি সমগ্র ইউরোপজুড়ে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও বাণিজ্যিক রূপ লাভ করে।
এ প্রসঙ্গে আঠারো শতক হতে উনিশ শতক পর্যন্ত কয়েকটি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা যাক-
১। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার পরাজয় ঘটে। বৃটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী সে সময় থেকেই সমগ্র ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করতে থাকে। পরবর্তীতে লণ্ডনে তারা একটি জাদুঘর গড়ে তোলে। নাম দেয়া হয় ভারত জাদুঘর।
২। ১৭৯৮ সালে নেপোলীয়ান মিশর আক্রমণ করেন। তিনি তার চারশত জাহাজে সৈনিক ও নাবিকের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক, প্রকৌশলী ও অজস্র পণ্ডিতদের নিয়ে আসেন। তাদের কাজ ছিল মিশরের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক উপাদান লুট করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রোসেটা স্টোন’, যা এসময় ফরাসীদের হাতে চলে আসে। । এটি পাথরে খোদাইকৃত একটি রাজকীয় ফরমান। মিশরীয় হায়রোগ্লিফের অর্থ পুনোরুদ্ধারে যা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৩। জিওভানী বেলজনী ছিলেন সার্কাসের আয়োজক । ১৮১৭-১৮২০ সাল পর্যন্ত তার লুটপাটে মিশরের বহু স্থাপনা ধুলায় মিশে যায়। তিনি ২য় রামসেস এর ভাস্কর্য লণ্ডনে পাঠান যা এখনো লণ্ডন মিউজিয়ামে রয়েছে।
৪। পরিব্রাজক জন লয়েড স্টেফান ও ফ্রেডরিখ ক্যাথারউড ১৮৪১-১৮৪৩ মায়া সভ্যতার পিরামিড ও অনান্য বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন।
৫। হোমারের মহাকাব্যের ট্রয় নগরীর খোঁজে জার্মান ব্যবসায়ী হেনরিখ শ্লীমান ১৮৭১-১৮৭৬ সালে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি রাজা আগামেনন এর সোনার মুখোশ খুঁজে বের করেন যা এথেন্সের জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
সংগৃহীত এসব নিদর্শনগুলো থেকে পরবর্তীতে আংশিকভাবে, মানব ইতিহাসের একটি ধারাবাহিক ব্যাখ্যা তৈরীর চেষ্টা শুরু হয়। পরবর্তীতে বহুবার যা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ডেনমার্কের জাতীয় জাদুঘরের পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান সি জে থম্পসন, যুগ বিভাজনের তিন-যুগ পদ্ধতি (প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ ও লৌহ যুগ) উপস্থাপন করেন। পরবর্তী কয়েক দশক পর্যন্ত প্রায় বিনা প্রশ্নে এ তত্ত্ব ব্যবহৃত হতে থাকে। কিন্তু স্থানভেদে যুগ বিভাজনে ভিন্নতা থাকতে পারে। তাছাড়া মানুষের সামাজিক অগ্রগতি ও তার বিভিন্ন সামাজিক ধাপ অতিক্রমের ক্ষেত্রে ব্যাখ্যাটি সঠিক নয়। একটি সার্বজনীন পদ্ধতি অনুসরণ করে মানুষের সামাজিক অগ্রগতিকে বোঝা সম্ভব নয়। পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক ন্যান্সি ম্যারী হোয়াইট তার বই Archaeology for Dummies- এর একটি অধ্যায়ে কতগুলো সুনির্দষ্ট বিষয় ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জোড়ালোভাবে বলেছেন যে এসব কোনভাবেই প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ড নয়।এরকম কয়েকটি সংজ্ঞা ও মতামত সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক-
প্রত্নতত্ত্বের সংজ্ঞা ও কয়েকটি মতামত
মার্থা জুকোস্কি
বিখ্যাত মাঠ প্রত্নতাত্ত্বিক মার্থা জুকোস্কি প্রত্নতত্ত্বের অসাধারণ একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন। তার ভাষায়- প্রত্নতত্ত্ব বিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যার মাধ্যমে; প্রাচীন মানুষের যে কোন অবশেষকে পদ্ধতিগত ভাবে ও নির্দিষ্ট কৌশল অবলম্বন করে অধ্যয়ন করা হয়। প্রাচীন সংস্কৃতি ও সমাজের যতটুকু সম্ভব একটি দৃশ্যপট তৈরী করা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে যে তথ্য সংগ্রহ করা হয় তার সাহায্যে, অতীতকালের জীবন যাপন পদ্ধতি কেমন ছিল তা পুনর্গঠনের চেষ্টা করা। অনেকেই বলতে পারে, পরিচয় নির্মাণের জন্য মানুষের মাঝে অস্তিত্বের সংকট তৈরী হয়। সেই তাড়না থেকে মানুষ নিজের দিক দিয়ে বিশ্বকে জানার চেষ্টা করে।
তবে আজকের বিশ্বে প্রত্নতত্ত্ব, বিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যা একই সাথে রোমাঞ্চকর অভিযান এবং পদ্ধতিগত অনুসন্ধানের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছে। তাছাড়া অনান্য শাখা যেমন- ভূতত্ত্ব, পরিবেশ বিদ্যা, ইতিহাস, ভাষাবিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, পরিসংখ্যান ও কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতির সাথে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
নেল অ্যাসচারসন
অধ্যাপক নেল অ্যাসচারসনকে একবার বলা হলো; প্রত্নতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বই সম্পর্কে আলোচনা করতে । পাঁচটি বইয়ের মধ্যে প্রথমেই তিনি বেছে নিলেন; আগাথা ক্রিস্টি রচিত, ‘বলো তুমি কীভাবে বেঁচে থাকো’। একটি আত্নজীবনীমূলক উপন্যাস হলেও, উপনিবেশিত রাষ্ট্রে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান কেমন হয় তার বিবরণ নিয়ে লেখা অসাধারণ একটি বই। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চলাকালে সিরিয়া ও ইরাকের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এমন প্রাণবন্ত বিবরণ অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তার আলোচনায় সর্বসাধারণের জন্য প্রত্নতত্ত্বের গুরুত্বের দিকটি বারবার চলে আসে। প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে তার অভিমত- রাষ্ট্রের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রত্নতত্ত্বের কাঠামোগত দিকটি তৈরী হয়। পেশা হিসেবে প্রত্নতত্ত্বের আবির্ভাবের সম্ভাবনা তৈরী হয় তখন থেকেই। ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিপ্রাপ্ত জাদুঘরের প্রসার এর একটি বড় উদাহরণ। সামরিক তত্তাবধায়নে জাদুঘরের পরিচালক নিয়োগ করা। মূল্যবান বস্তু সংগ্রহে বিভিন্ন অঞ্চলে, কর বা খাজনা আদায়কারীদের বিশেষ পদমর্যাদা দেয়া। এর মাধ্যমে যেমন জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষার সম্প্রসারণ হয়েছে, পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষাও হয়েছে।
তবে তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, জাতীয় আখ্যান তৈরীর আকাঙ্ক্ষা সাধারণত প্রত্নতত্ত্বকে প্রভাবিত করে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ডেনমার্কের রাজাদের কথা বলেছেন। একটি গৌরবময় অতীত নির্মাণের লক্ষ্যে তারা নিজেরাই প্রত্নতাত্ত্বিকের মতন খনন কাজে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন।
ন্যান্সি ম্যারী হোয়াইট
ন্যান্সি ম্যারী হোয়াইট একজন পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক। তিনি ফ্লোরিডা প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক। দক্ষিণ-পূর্ব মার্কিন প্রত্নতত্ত্ব, উত্তর আমেরিকার আদিবাসী পরিচিতি, দক্ষিণ আমেরিকা ও প্রত্নতত্ত্ব, ইউরোপের প্রাগৈতিহাসিক নৃতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তিনি পাঠদান করেন।
তার ভাষ্যমতে- যখন আমরা অজানাকে জানার জন্য চেষ্টা করি তখনই সেখানে নতুন অভিযানের আনন্দ পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান; অতীতকালের বিভিন্ন নিদর্শন উন্মোচনের পাশাপাশি, মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকার লড়াই করেছে তার নাটকীয় সব গল্প আমাদের কাছে উপস্থাপন করে। এসব গল্প বর্তমান কালের মানুষের জন্য শিক্ষা হতে পারে। সত্যিকার অর্থে প্রত্নচর্চা, একজন গোয়েন্দার রহস্য অনুসন্ধান ও সমাধান করার মতই রোমাঞ্চকর।
প্রত্নতত্ত্বের সংজ্ঞায় তিনি বলেন- প্রত্নতত্ত্ব পুরোনো জিনিস সম্পর্কে নতুন তথ্য সন্ধানের একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। প্রত্নতত্ত্ব; মানুষের ফেলে আসা বস্তুগত উপাদানগুলো অধ্যয়ন করার মাধ্যমে অতীত মানুষের আচরণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে। বস্তুগত উপাদান বলতে যে কোনো দৃশ্যমান বস্তু যেমন- মানুষের বসতির অবশিষ্টাংশ, বীজ বা শস্যদানা, অলংকারের অংশবিশেষ, কড়ি এমনকি মিশরের পিরামিডও এর অন্তর্ভুক্ত।
প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞান মানুষের সাথে সম্পর্কিত। প্রত্নতত্ত্ব অতীতকালের মানুষের রেখে যাওয়া বিভিন্ন বস্তুগত উপাদান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। যেখানেই মানুষের পদচিহ্ন পড়েছে সেখান থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের গল্প পাওয়া যায়। এসব গল্প মূলত মানুষেরই গল্প। প্রত্যেক মানুষই কিছু না কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করে থাকে। তার নিজের সাথে অবিচ্ছেদ্য এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টায় মত্ত থাকে।
সহজ ভাষায় প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে লেখা তার বইয়ের নামটিও বেশ মজার। Archaeology for Dummies বা নির্বোধের প্রত্নচর্চা। (যথাযথ অনুবাদের কাজটি নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের জন্য রেখে আমরা ‘নির্বোধের প্রত্নচর্চা’ ভাবানুবাদটি ব্যবহার করছি)
রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়
মহেঞ্জোদারো সভ্যতার সুপ্রাচীন ধংসাবশেষ আবিষ্কার তার অন্যতম কীর্তি। বাংলায় পাল রাজবংশ সম্পর্কিত বহু তথ্য তিনি আবিষ্কার করেন। তিনি পাহাড়পুরে খননকার্যের পরিচালক ছিলেন তিনি। মুদ্রা সম্পর্কে বাংলাতে প্রথম গ্রন্থ রচনা তার অন্যতম কৃতিত্ব। এছাড়াও কুষান সম্রাট কণিষ্ক সম্পর্কে তিনি যে সব তথ্য আবিষ্কার করেন তা প্রামান্য বলে বিবেচিত হয়েছে। তার উল্লেখযোগ্য রচনা বাঙ্গালার ইতিহাস, শশাঙ্ক ও ধর্মপাল।
হানিফ পাঠান ও হাবিবুল্লাহ পাঠান
হাবিবুল্লাহ পাঠানের বাবা হানিফ পাঠান ছিলেন একজন লোকসাহিত্য সংগ্রাহক। বাংলাদেশের প্রাচীন দুর্গনগরী ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান উয়ারী-বটেশ্বরকে তিনি সর্বপ্রথম জনসমক্ষে তুলে ধরেন। তারাই বাংলাদেশের স্বশিক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক।
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া
স্বশিক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, জীবনের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের প্রাচীন কীর্তিগুলো প্রবল আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। বাংলা ভাষায় সমগ্র দেশের প্রত্নসম্পদ নিয়ে লেখা একটি তথ্যবহুল বই- বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ। তার ভাষায়- প্রত্নতত্ত্ব আমার পেশা নয়, নেশা হয়ত বলা যেতে পারে।
স্বাধীন সেন
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে বিশেষ ভূমিকা পালন করছেন অধ্যাপক স্বাধীন সেন। তার নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান চলাকালে, মাধবগাঁও এলাকা থেকে দুর্লভ মোহিনী মূর্তিটি পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে প্রাপ্ত স্থাপনাটিকে বিষ্ণু মন্দির বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর সময়কাল আনুমানিক একাদশ থেকে দ্বাদশ শতক। ভারত উপমহাদেশের পূর্বাংশে পাওয়া এটিই প্রথম মোহিনী মূর্তি।
তথ্যনির্দেশ
১। বৃটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর সংগৃহীত প্রত্নবস্তু থেকে জাদুঘর গড়ে তোলার তথ্যটি পাওয়া যাবে এই লিংকে। https://www.britishmuseum.org/collection/term/BIOG123020।
২। Archaeology for Dummies by Nancy Marie White. Page: 15-17.
৩। প্রথম খননকারী অনুচ্ছেদে ব্যবহৃত রাজা নবোনিডাসের খননকার্য; পৃষ্ঠা: ১৫। Archaeology for Dummies by Nancy Marie White.
৪। A Complete Manual of Field Archaeology by Martha Joukowsky.
৫। বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ; আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া।
৬। অধ্যাপক নেল অ্যাসচারসনের সাক্ষাৎকার। https://fivebooks.com/best-books/best-books-archaeology-neal-ascherson/