মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপি

Reading Time: 3 minutes

মহাস্থানগড় ব্রাহ্মী লিপি, ‍খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের ব্রাহ্মী অক্ষরে উৎকীর্ণ একটি লিপি। এখানে ব্যবহৃত ভাষা প্রাকৃত।

খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে দুই ধরনের লিপি প্রচলন দেখা যায়। এর একটি ব্রাহ্মী লিপি, অপরটি খরোষ্ঠী লিপি। এই দুই লিপিতেই মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালের অসংখ্য শিলালিপি উৎকীর্ণ হয়। খরোষ্ঠী লিপি লেখা হতো ডান থেকে বামে; পক্ষান্তরে ব্রাহ্মীলিপি লেখা হতো বাম থেকে ডানে।

বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রাচীনতম নগর সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন মহাস্থানগড়। প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শনের ভিত্তিতে অনুমান করা যায় প্রাচীনকাল থেকে এখানে মানববসতি ছিল। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী লিপিতে কি লেখা রয়েছে তা নিয়ে বেশ কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

মহাস্থানগড় ব্রাহ্মীলিপির সম্ভাব্য কয়েকটি ব্যাখ্যা

মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপি। নৃ।

বিভিন্ন বই থেকে থেকে মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপির যে ব্যাখ্যাটি পাওয়া যায় তা নীহাররঞ্জন রায় রচিত বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থ থেকে নেয়া। ব্যাখ্যাটি নিম্নরূপ-

‘কোনো এক অত্যায়িক কালে রাজা পুন্দনগলের (পুণ্ড্রনগর-মহাস্থানগড়) মহামাত্রকে নির্দেশ দিতেছেন, প্রজাদের ধান্য ও এবং গণ্ডক ও কাকনিক মুদ্রা দিয়া সাহায্য করিবার জন্য, কিন্তু সুদিন ফিরিয়া আসিলে ধান্য ও মুদ্রা উভয়ই রাজভাণ্ডারে প্রত্যার্পণ করিতে হইবে তাহাও বলিয়া দিতেছেন’।

বাঙ্গালীর ইতিহাস,নীহাররঞ্জন রায়।

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া

বাংলাদেশে প্রত্নচর্চায় আ কা মো যাকারিয়া একজন নমস্য ব্যাক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক। মহাস্থান সম্পর্কে তার বক্তব্যটি নিম্নরূপ-

‘বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাসের সর্বপ্রাচীন প্রত্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে বগুড়া জেলার মহাস্থান গড়ে। এ শিলাখণ্ড লিপি মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলের বলে পণ্ডিত মহলের অভিমত। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বাঙলার প্রাচীন নগরগুলির মধ্যে মহাস্থান হচ্ছে প্রাচীনতম। প্রাচীনকালে এ স্থানের নাম ছিল পুণ্ড্রবর্ধন বা পুন্ড্রনগর’।

বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আ কা মো যাকারিয়া।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ব্যাখ্যা থেকে মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপিতে ‘সম্বঙ্গীয়’ শব্দটি ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্যাখ্যাটি নিম্নরূপ-

মহাস্থান ব্রাহ্মী শিলাফলক-লেখ প্রকৃতপক্ষে একটি রাজাদেশ যা পুণ্ড্রনগরের ‘মহামাত্র’ পদবীধারী শাসকের উদ্দেশ্যে জারি করা হয়। এ আদেশের মাধ্যমে পুণ্ড্রনগরের মহামাত্রকে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত ‘সম্বঙ্গীয়’ জনগোষ্ঠীকে শস্যাগার থেকে ধান ও কোষাগার থেকে গণ্ডক-মুদ্রা দিয়ে সাহায্য করার নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং রাজা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, সুদিনের সময় শস্যাগার ও কোষাগার পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।

লিপি, সিল ও সিলমোহর; আদি-ঐতিহাসিক যুগ থেকে প্রাক-মধ্যযুগ, আইয়ুব খান।

মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপি নিয়ে আরেকটি সহজবোধ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, বাংলাপিডিয়া থেকে। সারিতা ক্ষেত্রী রচিত ব্যাখ্যাটি বেশ সাবলীল।

এ শিলালিপিতে ‘পুডনগল’-এ (বাংলাদশের উত্তরাঞ্চলের পুন্ড্রনগর> মহাস্থান) কর্তব্যরত মহামাত্রের নিকট জারিকৃত জনৈক শাসকের একটি আদেশ লিপিবদ্ধ করা হয়। এতে সংবঙ্গীয় নামে পরিচিত শহর ও শহরতলীর অধিবাসীদের দুর্দশা দূর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিলালিপিতে চারটি প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা বলা হয়েছে, যেমন তেল (তৈল), ডুম (গাছ), ধান্য (ধান) এবং দুধরনের ক্ষুদ্রাকৃতি মুদ্রা-যার নাম গন্ডক (গন্ডা-একটি গণনার একক, চার কপর্দক অথবা কড়িতে এক গন্ডা) ও কাকমিক (কাকনিক-কপর্দক অথবা কড়ি)। গোলাঘর (কোঠাগল>কোষ্ঠাগার) উল্লিখিত প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীতে পূর্ণ করার নির্দেশ ছিল, যাতে যে কোন জরুরি অবস্থা- যেমন বন্যা, অগ্নিকান্ড বা তোতা পাখি দ্বারা শষ্য নষ্ট হলে তার মোকাবিলা করা যায়।

এ শিলালিপির ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানে যে, এটি পুন্ড্রবর্ধন অঞ্চলে মৌর্য শাসনের প্রাচীনতম সাক্ষ্য বহন করছে। এ শিলালিপি বাংলার যে কোন অঞ্চলের মধ্যে প্রথম নগরায়ণের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেয়। এটি পুন্ড্রবর্ধন অঞ্চলে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কড়ি প্রচলনের বিষয়েও আলোকপাত করে। এ লিপি থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনগণের দুর্দশার কথা এবং দুর্গতদের সাহায্যের জন্য গৃহীত প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কেও জানা যায়।

বাংলাপিডিয়া, সারিতা ক্ষেত্রী।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর ভাষ্যমতে, মহাস্থান ব্রাহ্মী শিলালিপি প্রজার কল্যাণে চুনা পাথরে খোদিত রাজাদেশ। সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)।

এতে ব্রাহ্মী অক্ষরে খোদাইকৃত রাজাদেশ এর অর্থ- পুণ্ড্রনগরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। খাদ্যশস্য ও অর্থ দিয়ে সাহায্য কর। সুদিন ফিরে এলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে তা ফেরত দিবে।

রোমিলা থাপার

গোরক্ষ বা গোরখপুরে প্রাপ্ত ‘সহগৌড়’ তাম্রলিপি ও বগুড়াতে প্রাপ্ত মহাস্থান শিলালিপি উভয়ই খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের ব্রাহ্মী লিপিতে উৎকীর্ণ। উভয় শিলালিপিতে দুর্ভিক্ষের সময় গৃহীত ত্রাণ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। রোমিলা থাপার এ লিপি চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে জারিকৃত বলে অনুমান করেছেন। বিভিন্ন  জৈন সূত্রে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে দুর্ভিক্ষের বিবরণ পাওয়া যায়। ‘সহগৌড়’ তাম্রলিপিতে ব্যবহৃত প্রতীকগুলোর সাথে মৌর্য সময়কালের ছাপাঙ্কিত বিভিন্ন মুদ্রার বেশ মিল পাওয়া যায়। মৌর্যশাসনের একেবারে প্রারম্ভিক যুগের হবার সম্ভাবনাও রয়েছে।

তথ্যসূত্র

বাঙ্গালীর ইতিহাস,নীহাররঞ্জন রায়।

বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, পৃষ্ঠা: ১১, ১৮৯-১৯০, আ কা মো যাকারিয়া।

প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। লিপি, সিল ও সিলমোহর; আদি-ঐতিহাসিক যুগ থেকে প্রাক-মধ্যযুগ,পৃষ্ঠা: ১৫৭, আইয়ুব খান।

বাংলাপিডিয়া। সারিতা ক্ষেত্রী।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

Asoka And The Decline Of The Mauryas, The Background And The Sources, Page: 7, Romila Thapar.

Recommended Posts

No comment yet, add your voice below!


Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *