মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপি

Reading Time: 3 minutes

মহাস্থানগড় ব্রাহ্মী লিপি, ‍খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের ব্রাহ্মী অক্ষরে উৎকীর্ণ একটি লিপি। এখানে ব্যবহৃত ভাষা প্রাকৃত।

খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে দুই ধরনের লিপি প্রচলন দেখা যায়। এর একটি ব্রাহ্মী লিপি, অপরটি খরোষ্ঠী লিপি। এই দুই লিপিতেই মৌর্য সম্রাট অশোকের রাজত্বকালের অসংখ্য শিলালিপি উৎকীর্ণ হয়। খরোষ্ঠী লিপি লেখা হতো ডান থেকে বামে; পক্ষান্তরে ব্রাহ্মীলিপি লেখা হতো বাম থেকে ডানে।

বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রাচীনতম নগর সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন মহাস্থানগড়। প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শনের ভিত্তিতে অনুমান করা যায় প্রাচীনকাল থেকে এখানে মানববসতি ছিল। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী লিপিতে কি লেখা রয়েছে তা নিয়ে বেশ কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

মহাস্থানগড় ব্রাহ্মীলিপির সম্ভাব্য কয়েকটি ব্যাখ্যা

মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপি। নৃ।

বিভিন্ন বই থেকে থেকে মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপির যে ব্যাখ্যাটি পাওয়া যায় তা নীহাররঞ্জন রায় রচিত বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থ থেকে নেয়া। ব্যাখ্যাটি নিম্নরূপ-

‘কোনো এক অত্যায়িক কালে রাজা পুন্দনগলের (পুণ্ড্রনগর-মহাস্থানগড়) মহামাত্রকে নির্দেশ দিতেছেন, প্রজাদের ধান্য ও এবং গণ্ডক ও কাকনিক মুদ্রা দিয়া সাহায্য করিবার জন্য, কিন্তু সুদিন ফিরিয়া আসিলে ধান্য ও মুদ্রা উভয়ই রাজভাণ্ডারে প্রত্যার্পণ করিতে হইবে তাহাও বলিয়া দিতেছেন’।

বাঙ্গালীর ইতিহাস,নীহাররঞ্জন রায়।

আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া

বাংলাদেশে প্রত্নচর্চায় আ কা মো যাকারিয়া একজন নমস্য ব্যাক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক। মহাস্থান সম্পর্কে তার বক্তব্যটি নিম্নরূপ-

‘বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাসের সর্বপ্রাচীন প্রত্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে বগুড়া জেলার মহাস্থান গড়ে। এ শিলাখণ্ড লিপি মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলের বলে পণ্ডিত মহলের অভিমত। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বাঙলার প্রাচীন নগরগুলির মধ্যে মহাস্থান হচ্ছে প্রাচীনতম। প্রাচীনকালে এ স্থানের নাম ছিল পুণ্ড্রবর্ধন বা পুন্ড্রনগর’।

বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, আ কা মো যাকারিয়া।

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি

বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ব্যাখ্যা থেকে মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপিতে ‘সম্বঙ্গীয়’ শব্দটি ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ব্যাখ্যাটি নিম্নরূপ-

মহাস্থান ব্রাহ্মী শিলাফলক-লেখ প্রকৃতপক্ষে একটি রাজাদেশ যা পুণ্ড্রনগরের ‘মহামাত্র’ পদবীধারী শাসকের উদ্দেশ্যে জারি করা হয়। এ আদেশের মাধ্যমে পুণ্ড্রনগরের মহামাত্রকে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত ‘সম্বঙ্গীয়’ জনগোষ্ঠীকে শস্যাগার থেকে ধান ও কোষাগার থেকে গণ্ডক-মুদ্রা দিয়ে সাহায্য করার নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং রাজা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, সুদিনের সময় শস্যাগার ও কোষাগার পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।

লিপি, সিল ও সিলমোহর; আদি-ঐতিহাসিক যুগ থেকে প্রাক-মধ্যযুগ, আইয়ুব খান।

মহাস্থান ব্রাহ্মী লিপি নিয়ে আরেকটি সহজবোধ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, বাংলাপিডিয়া থেকে। সারিতা ক্ষেত্রী রচিত ব্যাখ্যাটি বেশ সাবলীল।

এ শিলালিপিতে ‘পুডনগল’-এ (বাংলাদশের উত্তরাঞ্চলের পুন্ড্রনগর> মহাস্থান) কর্তব্যরত মহামাত্রের নিকট জারিকৃত জনৈক শাসকের একটি আদেশ লিপিবদ্ধ করা হয়। এতে সংবঙ্গীয় নামে পরিচিত শহর ও শহরতলীর অধিবাসীদের দুর্দশা দূর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিলালিপিতে চারটি প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা বলা হয়েছে, যেমন তেল (তৈল), ডুম (গাছ), ধান্য (ধান) এবং দুধরনের ক্ষুদ্রাকৃতি মুদ্রা-যার নাম গন্ডক (গন্ডা-একটি গণনার একক, চার কপর্দক অথবা কড়িতে এক গন্ডা) ও কাকমিক (কাকনিক-কপর্দক অথবা কড়ি)। গোলাঘর (কোঠাগল>কোষ্ঠাগার) উল্লিখিত প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীতে পূর্ণ করার নির্দেশ ছিল, যাতে যে কোন জরুরি অবস্থা- যেমন বন্যা, অগ্নিকান্ড বা তোতা পাখি দ্বারা শষ্য নষ্ট হলে তার মোকাবিলা করা যায়।

এ শিলালিপির ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানে যে, এটি পুন্ড্রবর্ধন অঞ্চলে মৌর্য শাসনের প্রাচীনতম সাক্ষ্য বহন করছে। এ শিলালিপি বাংলার যে কোন অঞ্চলের মধ্যে প্রথম নগরায়ণের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ দেয়। এটি পুন্ড্রবর্ধন অঞ্চলে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কড়ি প্রচলনের বিষয়েও আলোকপাত করে। এ লিপি থেকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে জনগণের দুর্দশার কথা এবং দুর্গতদের সাহায্যের জন্য গৃহীত প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কেও জানা যায়।

বাংলাপিডিয়া, সারিতা ক্ষেত্রী।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর ভাষ্যমতে, মহাস্থান ব্রাহ্মী শিলালিপি প্রজার কল্যাণে চুনা পাথরে খোদিত রাজাদেশ। সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতক, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়)।

এতে ব্রাহ্মী অক্ষরে খোদাইকৃত রাজাদেশ এর অর্থ- পুণ্ড্রনগরে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। খাদ্যশস্য ও অর্থ দিয়ে সাহায্য কর। সুদিন ফিরে এলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে তা ফেরত দিবে।

রোমিলা থাপার

গোরক্ষ বা গোরখপুরে প্রাপ্ত ‘সহগৌড়’ তাম্রলিপি ও বগুড়াতে প্রাপ্ত মহাস্থান শিলালিপি উভয়ই খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকের ব্রাহ্মী লিপিতে উৎকীর্ণ। উভয় শিলালিপিতে দুর্ভিক্ষের সময় গৃহীত ত্রাণ ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। রোমিলা থাপার এ লিপি চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে জারিকৃত বলে অনুমান করেছেন। বিভিন্ন  জৈন সূত্রে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে দুর্ভিক্ষের বিবরণ পাওয়া যায়। ‘সহগৌড়’ তাম্রলিপিতে ব্যবহৃত প্রতীকগুলোর সাথে মৌর্য সময়কালের ছাপাঙ্কিত বিভিন্ন মুদ্রার বেশ মিল পাওয়া যায়। মৌর্যশাসনের একেবারে প্রারম্ভিক যুগের হবার সম্ভাবনাও রয়েছে।

তথ্যসূত্র

বাঙ্গালীর ইতিহাস,নীহাররঞ্জন রায়।

বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, পৃষ্ঠা: ১১, ১৮৯-১৯০, আ কা মো যাকারিয়া।

প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। লিপি, সিল ও সিলমোহর; আদি-ঐতিহাসিক যুগ থেকে প্রাক-মধ্যযুগ,পৃষ্ঠা: ১৫৭, আইয়ুব খান।

বাংলাপিডিয়া। সারিতা ক্ষেত্রী।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।

Asoka And The Decline Of The Mauryas, The Background And The Sources, Page: 7, Romila Thapar.

কুঁজো মহিষের উপাখ্যান

Reading Time: 3 minutes

বরফের আচ্ছাদন

প্রায় ১১৭০০ বছর আগেকার কথা। তখন উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি থেকে ক্রমশ বরফের আচ্ছাদন সরে যাচ্ছে। উচুঁ প্যানিকাম ঘাসে ছেঁয়ে গেছে ‘ওয়ানাসকেউইন’ অঞ্চল। সবুজ ঘাসের লোভে কুঁজো মহিষের পাল এসে জড়ো হচ্ছে ‘ওপিমিহো’ জলধারার কাছে।

কুঁজো মহিষের উপাখ্যান
কুঁজো মহিষের ভাস্কর্য। ছবি: নৃ।
This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-ShareAlike 4.0 International License.

তাদের পিছুঁ নিয়েছে ধূসর রঙের শিকারী নেকড়ের দল। এরা একে অপরের সাথে লড়াই করে এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র টিকিয়ে রাখে। ধূসর নেকড়ের পাশাপাশি কয়েকদল শিকারী ও সংগ্রাহক গোষ্ঠী মহিষের পালকে অনুসরণ করতে থাকে। তাদের মধ্যে ‘ওজিবওয়ে’ ও ‘ক্রী’ জনগোষ্ঠী অন্যতম। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে ‘ওয়ানাসকেউইন হেরিটেজ পার্ক’ থেকে প্রায় ৬০০০ বছর আগে মানুষের বসতি স্থাপনের প্রমাণ মিলেছে।

সার্থক শিকারী

তারাই প্রথম নেকড়ের কাছে মহিষের পাল তাড়া করবার কৌশল জেনে নেয়। এছাড়াও সবচেয়ে দুর্বল বাছুড়টিকে ক্রমশ আলাদা করে ফেলার সহজ উপায়টিও তারা রপ্ত করে নেয়। পরবর্তীতে নিজেরাই মহিষ শিকারের অভিনব সব পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে থাকে। নতুন কৌশল শেখার মধ্য দিয়ে তাদের খাদ্য তালিকায় আমিষের যোগান সুনিশ্চিত হয়।মহিষ শিকারের দুইটি পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়। প্রথমটি গোলাকার ঘের বা ফাঁদ তৈরি করে মহিষ শিকার করা। দ্বিতীয়টি মহিষের পাল তাড়া করে, খাদে ফেলে শিকার করা

তীর ধনুক; ওয়ানাসকেউইন। ছবি: নৃ।
This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-ShareAlike 4.0 International License.

বিভিন্ন সময়কালে ওয়ানাসকেউইন বর্তমান থেকে অতীতে
হিমবাহ গলতে শুরু করেপ্রায় ১২০০০ বছর
বসতি স্থাপন৬০০০ বছর
মহিষ শিকারে ব্যবহৃত তীর, ধনুকের সন্ধান২০০০ বছর
মহিষ শিকারে ঘের বা ফাঁদ এর ব্যবহারপ্রায় ২০০০-৫০০ বছর
ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার শুরু১৫০০ বছর
‘ল্যাকরোজ’ খেলার উদ্ভাবন৫০০ বছর
This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-ShareAlike 4.0 International License.

তাবু

প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে আরো পাওয়া গেছে ২০০০ বছর পুরোনো তীর, ধনুক, কুঁজো মহিষের চামড়া দিয়ে বানানো তাবুর অবশেষ। ‘ক্রী’ জনগোষ্ঠীর ভাষায় এই তাবুর নাম ‘মিখিওয়াপ’। দৈনন্দিন জীবনে, সামজিক আচার ও মূল্যবোধের ক্ষেত্রে এর যথেষ্ঠ গুরুত্ব ছিলো। অনেকে একে ‘ঠিপি’ নামেও চেনে।

‘মিখিওয়াপ’ বা তাবু। ছবি: নৃ।
This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-ShareAlike 4.0 International License.

স্থায়ী বসতি

‘ওয়ানাসকেউইন’ শব্দের অর্থ যেখানে মনের প্রশান্তি পাওয়া যায়। এরকম নামকরণের কারণ অনুমান করা যায়। অফুরন্ত মিঠা পানি ও কুঁজো মহিষের প্রাধান্যই পরবর্তীতে যাাযাবর জাতিগুলোকে স্থায়ী বসতি স্থাপনে উৎসাহিত করেছিলো। এ কারণেই উত্তরের সমতল ভূমিতে হাজার বছর ধরে আদিবাসীরা তাদের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের জন্য এই কুঁজো মহিষের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে কানাডার সরকার একটি বৃহত্তর জাতীয় পরিচয় নির্মাণের লক্ষ্যে; সমতল ভূমি ও তার প্রথম অধিবাসীদের একটি সম্মিলিত উপাখ্যান রচনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

টাঁড়বারো

মহিষের গল্প শুনতে শুনতে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের কথা মনে পড়ে যায়। সেখানে গহীন অরণ্যে বুনো মহিষের দেবতা টাঁড়বারো বাস করেন। দীর্ঘাকৃতির; কালো ছায়ার মতন তার শরীর। সেখানে আদিবাসী সাঁওতালদের বিশ্বাস; মানুষ যখন বুনো মহিষ শিকারের জন্য ফাঁদ পেঁতে রাখে, তখন দেবতা টাঁড়বারো বুনো মহিষের পালকে রক্ষা করেন। যদিও মানুষ হাত থেকে মহিষের পালকে রক্ষা করা সহজ নয়।

তথ্যসূত্র

https://wanuskewin.com/


This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-ShareAlike 4.0 International License.

‘শিলুয়া’ ও দুর্বোধ্য লিপি

প্রাচীন লিপি বিশারদ দীনেশচন্দ্র সরকার, তার ‘পাল-পূর্ব যুগের বংশানুচরিত’ গ্রন্থে বাংলাদেশে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব যুগের দুটি শিলালেখ এর কথা উল্লেখ করেছেন।

Continue reading

সাকাশ্বর স্তম্ভ

স্তম্ভ বা পাথরকে পবিত্র ভেবে উপাসনা করা আদিকাল থেকে পরিচিত এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মে এ প্রচলন দেখা যায়। প্রায়শই এগুলি বিভিন্ন জাদুকরী অনুষ্ঠানের উপাদান বা ভবিষ্যদ্বাণীর মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া সীমানা পাথর বা স্মারক হিসাবেও ব্যবহার করা হয়। এই স্তম্ভ অদেখা শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে বলে বিশ্বাস স্থাপনের কারণে, মানুষ বারবার এর কাছে ফিরে আসে। কেল্টিক (Celtic) উৎসে এধরনের পাথরকে বলা হয় মেনহির (Menhir)।

Continue reading

লুট

Reading Time: 3 minutes

মানুষের ইতিহাসের সাথে জুড়ে আছে লুটপাটের ইতিহাস। যে কোনো যুদ্ধের ইতিহাসে; লুটপাট একটি সাধারণ উপজাত হিসেবে সবসময় উপস্থিত ছিল। প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মিশর আক্রমণের কথা আমাদের সবার জানা। তিনি তার চারশত জাহাজে সৈনিক ও নাবিকের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক, প্রকৌশলী ও অজস্র পণ্ডিতদের নিয়ে আসেন। তাদের কাজ ছিল মিশরের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক উপাদান লুট করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রোসেটা স্টোন’, পাথরে খোদাইকৃত একটি রাজকীয় ফরমান। এই ‘রোসেটা স্টোন’ মিশরীয় হায়রোগ্লিফের অর্থ পুনোরুদ্ধারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যা পরবর্তীতে ফরাসীদের হাতে চলে আসে।

তাই বলা যায়, প্রত্নতত্ত্ব চর্চার সাথে ‘লুট’ শব্দটির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তৎসম বা সংস্কৃত √লুট্ থেকে ‘লুট’ শব্দটির উৎপত্তি। ইংরেজি ‘Loot’ বা ‘Looting’ শব্দের উৎপত্তিও এই সংস্কৃত শব্দ থেকে।

জাদুঘরে সংরক্ষিত অধিকাংশ পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হয় লুটেরাদের কাছ থেকে কেনা অথবা সংগৃহীত।

ন্যান্সি ম্যারী হোয়াইট

এক্ষেত্রে জিওভানী বেলজনীর কথা বলতেই হয়। তিনি ছিলেন সার্কাসের আয়োজক । পুরাকীর্তি, প্রত্নবস্তুর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি পেশা বদল করে পুরাতত্ত্ব সংগ্রহ করতে থাকেন। ১৮১৭-১৮২০ সাল পর্যন্ত তার লুটপাটে মিশরের বহু স্থাপনা ধুলায় মিশে যায়। তিনি ২য় রামসেস এর ভাস্কর্য লণ্ডনে পাঠান যা এখনো লণ্ডন জাদুঘরে রয়েছে।

একই কারণে, প্রাথমিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান বা খনন কাজগুলো; প্রাচীন কোনো স্থাপনাকে কেন্দ্র করে অথবা প্রদর্শন মূল্য রয়েছে এমন বস্তু বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের উদ্দেশে পরিচালিত হতো। শুধুমাত্র লুটপাটের কারণে, প্রাচীন যে কোন সমাধি বা প্রাগৈতিহাসিক স্থান অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায় না।

১৮৪০ সাল পর্যন্ত প্রত্নতত্ত্ব, ধনী ও হঠকারী সংগ্রাহকদের শখের পেশা হিসেবে বিবেচিত হতো। অপেশাদার ইতিহাসবিদ, ভূতাত্ত্বিকদের কাছে তা ছিল যে কোন আকর্ষণীয় বস্তু সংগ্রহের প্রক্রিয়া মাত্র। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব প্রত্নবস্তু কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তার কোন লিখিত সুত্র বা উৎস পাওয়া যায় নি

মার্থা জুকোস্কি
চিমু সভ্যতার মৃৎপাত্র

প্রত্নবস্তু পুনর্ব্যবহারের কারণে অনেক সময় সাধারন মানুষকে দায়ী করা হয়। কিন্তু মানুষ হাজার বছর ধরে বিভিন্ন প্রত্নবস্তু পুনর্ব্যবহার করে আসছে। তাছাড়া মানুষের জীবন জীবিকা স্থান কাল নিরপেক্ষ নয়। তাই কখনও কখনও দেখা যায় একজন শ্রমিক বা কৃষক চাষাবাদের সময় খুঁজে পাওয়া কোনো পাত্র বা প্রত্নবস্তু বিক্রি করে দেয়। যেমন- ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে উয়ারী গ্রামে মাটি খননকালে শ্রমিকেরা একটি মৃৎপাত্রে সঞ্চিত কিছু রৌপ্যমুদ্রা পান। যার অধিকাংশই তাঁরা স্থানীয় বেনেদের কাছে বিক্রি করে দেন। বন্ধু ম্যাথিউর সাথে আড্ডায় এমন একটি গল্প পাওয়া যায়। আট বছর আগে পেরু ভ্রমণকালে স্থানীয় একটি বাজার থেকে কেনা মাটির পাত্র নিয়ে এই গল্প। প্রাথমিক পরীক্ষা থেকে জানা যায় পাত্রটি চিমু সভ্যতার সাথে সম্পর্কিত।   

সাধারন মানুষের মাঝে সংরক্ষণের প্রবণতাই বেশী। যেমন- উয়ারী-বটেশ্বরে মোহাম্মাদ হানীফ পাঠান শ্রমিকদের কাছ থেকে ২০-৩০টি মুদ্রা সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। তখন থেকেই উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের সূচনা।

একই রকম গল্প পাওয়া যায় চীনের কৃষকেদের মাঝে। তারা কূপ খননের সময় কতগুলো পোড়ামাটির মূর্তি আবিষ্কার করেন; মাটির নীচে, সমাধির প্রশস্ত পথ দেখতে পান। পরবর্তীতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে জানা যায় এ সমাধি প্রায় ২০০০ বছর পুরোনো; ২৪৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দে সম্রাট চিন শি ওয়াং- এর সময়কালের।

ক্রেতা, সংগ্রাহক ও ব্যবসায়ীরাই সাধারনত আন্তর্জাাতিক বাজারের নিয়ন্ত্রক। তারা নিলামের উদ্দেশ্যে প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন পাচার করে অথবা বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। সাম্প্রতিক একটি ঘটনা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ সালের নভেম্বরে, ডার্বির হ্যানসন নামক একটি নিলামকারী প্রতিষ্ঠানে খুঁজে পাওয়া যায় ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটি মৃৎপাত্র। বছর খানেক আগে, মার্টিন নামক একজন কর্মচারী মাত্র ৪ ইউরোতে যা কিনেছিলো। একই প্রতিষ্ঠানের পুরাকীর্তি বিশেষজ্ঞ জেমস ব্রেঞ্চলি পরবর্তীতে নিশ্চিত করেন মৃৎপাত্রটি প্রায় ৪০০০ বছর পুরোনো। এর কারিগর সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার মানুষ।

সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র

এখনও প্রাচীন সভ্যতার ‍বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান লুট হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক শিক্ষা ও সচেতনতা অবশ্যই সমাধান। মানুষকে বুঝতে হবে যে, লুটপাটের মাধ্যমে একটি জাতির প্রাচীন বংশধারার মুছে ফেলার পাশাপাশি তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনষ্ট করা হয়। কিন্তু যুদ্ধ ও লুটপাট যে মানবতার জন্য অপরাধ তা উপলব্ধি করা সহজ নয়।

তাই প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের ব্যপারে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি; অনেক তথ্য অনুপস্থিত থাকা সত্বেও তারা প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে অতীতের ঘটনাগুলো ব্যাখ্য করার চেষ্টা করেন।

তথ্যসূত্র

Archaeology for Dummies; Page: 28, 238, 279.

উয়ারী-বটেশ্বর : শেকড়ের সন্ধানে, পৃষ্ঠা: ২৩।

Image credit: https://ancientart.as.ua.edu/looting-the-ancient-middle-east/

সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র। Indus Valley Pottery By Hansons Actioneers


This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-ShareAlike 4.0 International License.

‘নৃ’ অর্থ মানুষ

Reading Time: 5 minutes

’নৃ‘ অর্থ মানুষ। Anthropology শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘নৃবিজ্ঞান’। অর্থাৎ নৃবিজ্ঞান হচ্ছে মানুষ বিষয়ক বিজ্ঞান। মানুষের ডিএনএ থেকে শুরু করে তার মুখের ভাষা পর্যন্ত প্রায় সবকিছু নৃবিজ্ঞানে আলোচনা করা হয়। যেমন- Biological Anthropology (Or Physical Anthropology) বা জীবতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানে জীব বা প্রাণী হিসেবে মানব প্রজাতিকে অধ্যয়ন করা হয়। নৃবিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা Archaeology বা প্রত্নতত্ত্ব। বর্তমানে যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করা হয় তার অধিকাংশই নৃবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া Linguistics বা ভাষাবিদ্যা এবং Cultural Anthropology বা সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, পৃথক দুটি শাখা হিসেবে নৃবিজ্ঞানে অধ্যয়ন করা হয়।

(এই পর্বে শুধুমাত্র Archaeology বা প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে লেখা হয়েছে। পরবর্তী পর্বে নৃবিজ্ঞানের অনান্য শাখাগুলি নিয়ে বিস্তারিত লেখা হবে।)

প্রত্নতত্ত্ব

অনেকের কাছেই প্রত্নতত্ত্ব বা প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান মানে, উত্তেজনায় ভরপুর নতুন কোনো অভিযান। কারো কারো মতে তা ভাবপ্রবণ মানুষের কৌতুহল মাত্র। কিংবা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান। অধ্যাপক ন্যান্সি ম্যারী হোয়াইট অবশ্য তিনটি মতামতকেই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। সহজ ভাষায় প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে লেখা তার বইয়ের নামটিও বেশ মজার- “Archaeology For Dummies” ।

Dummy বা ডামি হল মানুষের কৃত্রিম প্রতিকৃতি। বাংলায় যার ভাবার্থ হিসেবে ভাবলেশহীন, বোকা, নির্বোধ, আহাম্মক, মূর্খ, গবেট ও জড়বুদ্ধি এই শব্দগুলো পাওয়া যায়। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে; যে কোনো বিষয়ে একাধিক প্রশ্ন করা হলে সাধারণত তুচ্ছার্থে এই শব্দগুলো উপাধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেইসব বোকা মানুষের জন্য লেখা এই বই।

Archaeology for Dummies -এর যথাযথ অনুবাদের কাজটি নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের জন্য রেখে আমরা ‘নির্বোধের প্রত্নচর্চা’ ভাবানুবাদটি ব্যবহার করছি। প্রত্নতত্ত্বের খুটিনাটি নিয়ে জানার আগে আমরা লেখকের কথা কিছুটা জেনে নেই।

ন্যান্সি ম্যারী হোয়াইট

অধ্যাপক ন্যান্সি ম্যারী হোয়াইট একজন পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক। ফ্লোরিডা প্রত্নতত্ত্ব, দক্ষিণ-পূর্ব মার্কিন প্রত্নতত্ত্ব, উত্তর আমেরিকা আদিবাসী পরিচিতি, দক্ষিণ আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ব, ইউরোপীয় প্রাগৈতিহাসিক নৃতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব পরিচিতি প্রভৃতি বিষয়ে তিনি পাঠদান করেন।

তার ভাষ্যমতে- যখন আমরা অজানাকে জানার জন্য চেষ্টা করি তখনই সেখানে নতুন অভিযানের আনন্দ পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান; অতীতকালের বিভিন্ন নিদর্শন উন্মোচনের পাশাপাশি, মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকার লড়াই করেছে তার নাটকীয় সব গল্প আমাদের কাছে উপস্থাপন করে। এসব গল্প বর্তমান কালের মানুষের জন্য শিক্ষা হতে পারে। প্রত্নতত্ত্বের প্রকৃতি নিয়ে ভুল ধারণার ছড়াছড়ি প্রায় সবখানে। তাই এই অধ্যায়ে প্রত্নতত্ত্বের সঙ্গা নিয়ে আলোচনা করবো। সত্যিকার অর্থে প্রত্নচর্চা, একজন গোয়েন্দার রহস্য অনুসন্ধান ও সমাধান করার মতই রোমাঞ্চকর।

প্রত্নতত্ত্বের সহজ সংজ্ঞা

প্রত্নতত্ত্ব পুরোনো জিনিস সম্পর্কে নতুন তথ্য সন্ধানের একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। প্রত্নতত্ত্ব; মানুষের ফেলে আসা বস্তুগত উপাদানগুলো অধ্যয়ন করার মাধ্যমে অতীত মানুষের আচরণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে। বস্তুগত উপাদান বলতে যে কোনো দৃশ্যমান বস্তু যেমন- মানুষের বসতির অবশিষ্টাংশ, বীজ বা শস্যদানা, অলংকারের অংশবিশেষ, কড়ি এমনকি মিশরের পিরামিডও এর অন্তর্ভুক্ত। 

প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞান মানুষের সাথে সম্পর্কিত। প্রত্নতত্ত্ব অতীতকালের মানুষের রেখে যাওয়া বিভিন্ন বস্তুগত উপাদান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। যেখানেই মানুষের পদচিহ্ন পড়েছে সেখান থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের গল্প পাওয়া যায়। এসব গল্প মূলত মানুষেরই গল্প। বলা হয়, প্রত্যেক মানুষই কিছু না কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করে থাকে। তার নিজের সাথে অবিচ্ছেদ্য এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টায় মত্ত থাকে।

প্রত্নতত্ত্বের লক্ষ্য: মানুষকে বুঝতে পারা

প্রত্নতত্ত্বের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে-

১. ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের, বিভিন্ন স্থানের মানুষের অতীতকে অধ্যয়ন করা।

২. অতীতকালের মানুষের আচরণ ও জীবনযাপন পদ্ধতি পুনর্গঠন করা।

৩. প্রাচীনকালের সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা (সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়) বুঝতে পারা ও কীভাবে তা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে তা অনুসন্ধান করা।

৪. ভঙ্গুর প্রত্নবস্তু সংরক্ষণ করা এবং ঐতিহ্যকে বর্তমান মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করা।

৫. অতীতকালের এই গল্পগুলো সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে আসা; যেন তারা শিক্ষা বা ব্যবহারিক কাজে, বিনোদনের জন্য হলেও তা উপভোগ করতে পারে।

পদ্ধতি: গোয়েন্দাগিরি করা

রহস্য অনুসন্ধান ও সমাধান করার জন্য একজন গোয়েন্দা যে সকল পদ্ধতি ব্যবহার করেন; একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের কাজ অনেকাংশে একই রকম।

১. প্রত্নবস্তু বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অথবা প্রত্নস্থল; সাবধানে পরিমাপ করা, প্রমাণ সংগ্রহ করা, তথ্য সংরক্ষণ করা এবং ছবি তোলা (ঠিক যেন অপরাধী সনাক্তকরণে ঘটনাস্থলে একজন বিচক্ষণ গোয়েন্দার কর্মকাণ্ড)।

২. প্রত্নস্থলে তথ্য সংরক্ষণ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য কাজ। তাই যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে ও বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে তথ্য সংরক্ষণ করা।

৩. প্রত্নস্থলে কাজ শুরুর আগে সে স্থানের পটভূমি, সেখানকার মানুষ ও তার ইতিহাস, সময়কাল সম্পর্কে যথাসম্ভব তথ্য যোগাড় করা।

৪. প্রত্নস্থলটির ক্ষেত্রে কি ঘটেছিলো জানতে আশেপাশের মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়া।

৫. প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ জোগাড়ের ক্ষেত্রে পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নের মতো অনান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সহযোগিতা নেয়া।

৬. প্রত্নস্থলে কি ঘটেছিলো তা জানতে সমস্ত তথ্য সংকলন করা।

৭. কাজ শুরু করা। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই বাছাই করা ও প্রশ্ন করা। অনান্য বিশেষজ্ঞদের কাজের সাথে যুক্ত করা।

৮. সিদ্ধান্তে আসার আগ পর্যন্ত অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া।

আমরা সবাই প্রত্নতাত্ত্বিক

আবার পুরানো কথায় ফেরা যাক। আমরা আগেই জেনেছি যে, Dummy অর্থাৎ মানুষের কৃত্রিম প্রতিকৃতি। বাংলায় যার ভাবার্থ হিসেবে ভাবলেশহীন, বোকা, নির্বোধ, আহাম্মক, মূর্খ, গবেট ও জড়বুদ্ধি এই শব্দগুলো পাওয়া যায়। সেইসব বোকা মানুষের উদ্দেশ্যেই লেখক বলছেন যে- প্রত্যেকেই কিছু না কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ করে প্রায় প্রতিদিনই। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞান আমাদের উপলব্ধি করতে সহযোগিতা করে, যে হাজার বছর আগে বেঁচে থাকা মানুষের সাথে আমাদের জীবনের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা রয়েছে। এই হাজার বছরে মানুষের খুব সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা, ভয় এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের উদ্বেগ পূর্বের যুগের মানুষের থেকে এতটা আলাদা নয়।

প্রত্নতত্ত্বের প্রকৃতি ও কয়েকটি সংজ্ঞা

বিজ্ঞানের অনান্য শাখার মতো প্রত্নতত্ত্বেরও নিজস্ব কিছু ভাষা রয়েছে। যে কোন আলোচনা শুরুর পূর্বে তাই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া দরকার।

Archaeology বা প্রত্নতত্ত্ব

আমরা এই শব্দটির সাথে পরিচিত হয়েছি। তবে অনেক সময় Archaeology ও Archeology শব্দ দুটির বানান পার্থক্য দেখে আমরা দ্বিধায় পড়ে যাই। দুটি শব্দেরই বাংলা প্রতিশব্দ প্রত্নতত্ত্ব। সাধারনত সম্পাদক বা প্রকাশকদের মাঝে Archaeology শব্দটি বেশী জনপ্রিয়।

Artifact বা নিদর্শন

মানুষের তৈরী যে কোন কিছুকেই প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় Artifact বা নিদর্শন বলে। প্রত্নতত্ত্বের ভাষায়, মানবসৃষ্ট যে কোন দৃশ্যমান বস্তু যা পরিমাপ করা যায় ও যা থেকে তথ্য পুনরুদ্ধার করা যায় তাই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এমনকি মানুষের লেখা গান, কবিতা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। প্রস্তর যুগে পাথরের হাতিয়ার তৈরীর জন্য কিছু পাথর হাতুড়ির মত ব্যবহার করা হতো। এক্ষেত্রে হাতিয়ার ও ব্যবহৃত পাথর খণ্ড দুটোই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রত্নস্থল থেকে সংগৃহিত তথ্য, মানচিত্র ও ছবি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হবে।

Ecofact বা জৈব নিদর্শন

ইকোফ্যাক্ট শব্দটি যা প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আবিষ্কার করেছেন। প্রাচীনকালে কোন রকম পরিবর্তন ছাড়াই প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান মানুষ তার নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতো। এসব নিদর্শনকে বলা হয় জৈব নিদর্শন। যেমন- যে কোন প্রাণীর হাড়। অনেক সময় তা হাতুড়ী হিসেবে ব্যবহৃত হত কোন পরিবর্তন ছাড়াই। কিন্তু পরিবর্তিত আকারে ব্যবহার করা হলে তাকে বলা হয় নিদর্শন। যেমন- প্রাচীন কালে মানুষের ফেলে যাওয়া আবর্জনা মাটির সাথে মিশে ফসফেট তৈরী করে। প্রত্নস্থলে ফসফেটের উপস্থিতি অনেক সময় জৈব নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু প্রাণীর হাড় থেকে তৈরী করা বাঁশিকে নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়।

Site বা প্রত্নস্থল

প্রত্নস্থল বলতে এমন জায়গা বোঝায় যেখানে মানব বসতি গড়ে উঠেছিলো বা অনান্য কর্মকাণ্ড ছিল এবং যেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে সম্ভাব্য প্রত্নস্থলের সন্ধানে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ করা হয়।

Components & Boundaries বা উপাদান ও সীমানা

বিভিন্ন প্রত্নস্থলে দেখা যায় যে, ইতিমধ্যে ব্যবহৃত স্থানটিতে পূর্ববর্তী কালের মানুষেরা বিভিন্ন চিহ্ন রেখে যায়। প্রত্নতত্ত্বের ভাষায়, প্রত্নস্থলে একটি উপাদান যুক্ত করা হলো। অনেক সময় একাধিক উপাদানের চিহ্ন বিভিন্ন প্রত্নস্থলে পাওয়া যায়। মূল প্রত্নস্থলে, পাশাপাশি কয়েক হাজার বছর পুরোনো সাংস্কৃতিক উপাদান পাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে প্রত্নস্থলের সীমনা নির্ধারণ করা বেশ দুরূহ ব্যাপার। কোনও প্রত্নস্থলের সীমানা অনুসন্ধান করা একই সময়ে জটিল এবং প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ব্যাতীত প্রায় অসম্ভব।

কিভাবে প্রত্নস্থল গঠিত হয়?

প্রত্নস্থল গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে মানুষ, প্রকৃতি ও সময়। প্রত্নস্থল গঠন প্রক্রিয়াকে প্রধানত দুই ভাগে করা যায়।

Cultural Process বা সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া এবং Natural Process বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।

Cultural Process বা সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া

সহজ ভাষায়; প্রত্নস্থল গঠনের সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া হল মানুষ তার জীবন যাপনের জন্য যা কিছুই করে তা প্রত্নস্থলটিতে বস্তুগত উপাদান, নিদর্শন বা প্রমাণ হিসেবে যুক্ত হতে পারে। যেমন-

১। নিদর্শন তৈরীঃ আমরা আগেই জেনেছি, প্রস্তর যুগে পাথরের হাতিয়ার তৈরীর জন্য কিছু পাথর হাতুড়ির মত ব্যবহার করা হতো। এক্ষেত্রে প্রত্নস্থলে প্রাপ্ত হাতিয়ার ও ব্যবহৃত পাথর খণ্ড দুটোই সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার সংযুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এর মাধ্যমে প্রত্নস্থলটির সীমানা অনুসন্ধান করা সম্ভব। প্রত্নস্থলটিতে পাশাপাশি কয়েক হাজার বছর পূর্ববর্তী বা পরবর্তী সাংস্কৃতিক উপাদান পাওয়া অসম্ভব নয়।

২। ক্রিয়াকলাপের প্রমাণ রেখে যাওয়াঃ মানুষ যখন কোন জায়গায় বসতি স্থাপন করে ও পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে তখন সেখানে ব্যবহৃত এসব উপাদানের অবশেষ রেখে যায়। মানুষ দীর্ঘকাল থেকে পুনঃব্যবহার ও মেরামতের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তুগত উপাদান ব্যবহার করে আসছে। এসব ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন চিহ্ন বা ধ্বংসাবশেষ রেখে যায়।

৩। বাতিলকৃত উপাদানঃ জঞ্জালতৈরী করা মানুষের পুরোনো স্বভাব। হাজার বছর পুরোনো মানুষের বাতিলকৃত বিভিন্ন উপাদানও প্রত্নস্থল গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন আমাদের তৈরী করা পলিথিন কয়েক লক্ষ বছর পরও প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিরক্তির উদ্রেক ঘটাবে।

৪। ভুলে যাওয়া মূল্যবান বস্তুঃ গোপনে মজুদ করে রাখা বা অতিরিক্ত সম্পদ লুকিয়ে রাখাও মানুষের বহু পুরোনো স্বভাব। অনেক সময় মানুষ লুকিয়ে রাখা এসব সম্পদ সম্পর্কে ভুলে যায়। প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত মজুদকৃত এসব উপাদান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়।

Natural Process বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া

প্রকৃতিও বিভিন্ন প্রত্নতাত্তিক উপাদান ও প্রত্নস্থল গঠন করে থাকে। যেমন বাতাস, মাধ্যাকর্ষণ, বৃষ্টিপাত, ঝড়, খরা, আগ্নেয়গিরি( পম্পেই শহরজুড়ে আগ্নেয় ছাই) এবং স্থানীয় আবহাওয়া বা জলবায়ু প্রত্নস্থল গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের প্রত্নস্থল গঠনে নদী, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, পলি গঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া জৈবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন উপাদানে ক্ষয়সাধন করে।

রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মধ্যে আবহাওয়ার কারণে পাথরের ক্ষয় বা ভাঙ্গন, লোহায় মরিচা পড়া(লোহার তৈরী যে কোন নিদর্শনের প্রাকৃতিক পরিবর্তন), মৃত ও পচনশীল গাছপালা ও মৃত প্রাণীর মাটিতে অ্যাসিড বা অম্লতা তৈরীও প্রত্নস্থল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো ভাবতে হলে এই সমস্ত প্রক্রিয়া, তার প্রভাব ও এদের মধ্যে পার্থক্য নিশ্চিত করতে হবে।

তথ্যনির্দেশ

১। Archaeology: Seeing Past People Today, Archaeology for Dummies by Nancy Marie White.


This work is licensed under a Creative Commons Attribution 4.0 International License.

সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র

সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র
Reading Time: 2 minutes

২০১৮ সালের নভেম্বর মাসের সোমবারের কথা। চমৎকার আবহাওয়ার কারণে, হ্যানসন নামক নিলামকারী প্রতিষ্ঠানের সবাই বেশ উৎফুল্ল। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মার্টিন পেশায় একজন সংগ্রাহক। প্রাচীন জিনিসপত্র, শিল্পকর্মের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ থেকে প্রায় সাত বছর ধরে সে একই পেশায় কাজ করছে। ডার্বির ধনী ব্যবসায়ীদের শখের জিনিসপত্র, সংগ্রহ নিয়ে এবারের নিলাম অনুষ্ঠান; তাই সে বেশ আগ্রহী।

অনান্য দিনের মতো মার্টিন, হ্যানসনের পুরাকীর্তি বিশেষজ্ঞ জেমস ব্রেঞ্চলির সাথে কাজ করছিল। পুরাকীর্তি বোঝাই ভ্যান থেকে কিছু মৃৎপাত্র আলাদা করার সময় সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। মৃৎপাত্রের গায়ে আঁকা ছবির সাথে; তার নিজের সংগ্রহে থাকা একটি ছোট্ট মাটির পাত্রের সাদৃশ্য আছে কিনা তাই বসে ভাবতে থাকে। হতে পারে তা সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র। বছর খানেক আগে, আরো বেশ কিছু মাটির পাত্রের সাথে মাত্র ৪ ইউরোতে যা সে কিনেছিলো। মৃৎপাত্রটি দেখামাত্রই তার পছন্দ হয়ে যায়। দুর্ভাগ্যবশত, সে পাত্রটিকে টুথব্রাশ রাখার কাজে ব্যবহার করে আসছিল।

সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র
Indus Valley Pottery By Hansons Auctioneers

পুরাকীর্তি বিশেষজ্ঞ জেমস ব্রেঞ্চলির সাথে আলাপ করে সে নিশ্চিতভাবে জানতে পারে যে, মৃৎপাত্রটি আনুমানিক ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের অর্থাৎ প্রায় ৪০০০ বছর পুরোনো। মৃৎপাত্রটির কারিগর সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার মানুষ। নির্মাণশৈলী, মৃৎপাত্রের গায়ে নকশা আাঁকার কৌশল, নকশার উপাদানে একশৃঙ্গ বিশিষ্ট কাল্পনিক হরিণের ছবি এসব দেখে সহজেই বলে দেয়া যায় যে এটা সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র।

তবে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সাধারনত বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে মৃৎপাত্রের ধরণ, প্রকার ও সময়কাল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন। প্রত্নতত্ত্বে মৃৎশিল্পের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, প্রত্নস্থল থেকে উদ্ধার করা প্রধান নিদর্শনের মধ্যে মৃৎপাত্র অন্যতম। মৃৎপাত্রের ছোট টুকরা বা ভাঙ্গা অংশ; প্রত্নতাত্ত্বিক অবশেষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোনো সমাজের আর্থ-সামাজিক জীবনধারা অধ্যয়নের জন্য মৃৎপাত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

একটি প্রত্নস্থল থেকে কী পরিমাণে মৃৎপাত্র বা ভাঙ্গা টুকরা পাওয়া যাচ্ছে তা থেকেও অনেক তথ্য পাওয়া সম্ভব। যেমন- মৃৎপাত্র তৈরীর সংশ্লিষ্ট উপাদান, নকশার ধরণ ও প্রকারভেদ থেকে নদী তীরবর্তী গ্রাম বা নগর সভ্যতা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যেতে পারে। আবার একই প্রত্নস্থলে প্রাপ্ত আকারে ও নকশা ভেদে, ভিন্ন ভিন্ন মৃৎপাত্র অনেকসময় একই সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায়কাল নির্দেশ করতে পারে। তাছাড়া প্রত্নস্থলে মৃৎপাত্রটি কোন স্তরে পাওয়া যাচ্ছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মৃৎপাত্র থেকে কি করে সময়কাল নির্ণয় করা সম্ভব? কোনো মৃৎপাত্রের অবশেষ বা নমুনাকে যদি উপাদান ও সীমানা বিচারে, প্রত্নস্থল থেকে যথাযথ ভাবে উদ্ধার করা যায়, তাহলে থার্মোলুমিনেসেন্স পদ্ধতির সহায়তায় অনেক তথ্য পুনরোদ্ধার করা সম্ভব। পরবর্তী পর্বে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা থাকছে। এর মাঝে আমরা সিন্ধু সভ্যতার অন্য একটি মৃৎপাত্রের সাথে সাধারন একটি তুলনা করতে পারি। দুটি পাত্রের ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যেতে পারে মাটির রং অথবা নকশাতে ইউনিকর্ন বা কাল্পনিক হরিণের ব্যবহার।

সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র

Indus Valley Pottery By Gary Todd

তথ্যসূত্র

Indus Valley Pottery By Hansons Auctioneers


This work is licensed under a Creative Commons Attribution 4.0 International License.

কচ্ছপ দ্বীপের উপাখ্যান

Reading Time: 4 minutes

কিন্তু গল্প বলা তো থেমে থাকতে পারে না; লিখিত ইতিহাসে যেইসব গল্প পাওয়া যায় না। কানাডার আদিবাসী মানুষেরা সেইসব গল্প বলা’কে তাদের জীবন যাপনের পথ নির্দেশনা বলে বিশ্বাস করতো। প্রধানত দুই ধরনের মৌখিক গল্পের প্রচলন ছিল। এক ধরনের গল্পে- ব্যাক্তির অভিজ্ঞতা, নির্দিষ্ট কোনো স্থানের নামকরণের কাহিনী, পর্যবেক্ষণ বা উপলদ্ধি মূলক বিবরণ পাওয়া যায়। এধরনের গল্পগুলো সময়ের সাথে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও প্রাসঙ্গিকতার বিচারে তা পরিবর্তিত হতে থাকে। সমাজের সকল স্তরেই এসব উপাখ্যানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শিক্ষণীয় এসব গল্পের মাধ্যমে; নিজস্ব ইতিহাস ও পরিবেশ সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি তৈরী হতো। গল্প বলার প্রচলন; তাদের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। দ্বিতীয় ধরনটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত যা সাধারনত সৃষ্টির গল্প, কিংবদন্তি বা পৌরাণিক গল্প হিসেবে পরিচিত। এইসব গল্পের আত্মিক দিকটি সময়ের সাথে অপরিবর্তিত থেকে যায়।

কচ্ছপ দ্বীপের গল্পকেও সৃষ্টির গল্প বলা যায়; যার কোনো লিখিত রূপ ছিল না। মৌখিকভাবে এ গল্প বলা হতো। গল্প শেষ করতে পুরো এক দিন কখনোই যথেষ্ঠ সময় ছিলো না। কখোনো গল্প শেষ করতে এক সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। আদিবাসী সম্প্রদায় ভেদে কচ্ছপ দ্বীপের গল্পে নানা রকম পরিবর্তন দেখা যায়। তবে বেশিরভাগ গল্পেই জীবন এবং পৃথিবীর রূপক হিসেবে কচ্ছপের ব্যবহার হয়েছে। আমাদের মূল লেখা নেহিয়াওয়াক জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত গল্প নিয়ে। প্রাসঙ্গিক আলোচনা হিসেবে ওজিবওয়ে এবং হডনেসোনী জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত গল্পের সংস্করণ কিছুটা থাকবে।

Nehiyawak বা নেহিয়াওয়াক

নেহিয়াওয়াক শব্দের অর্থ যারা একই ভাষায় কথা বলে। সাধারনত নেহিয়াওয়াক বলতে ‘ক্রি’ জনগোষ্ঠীকে বোঝায়। তাদের কচ্ছপ দ্বীপের গল্প শুরু হয় ‘কায়াস’ শব্দটি দিয়ে, বাংলায় যার অর্থ- অনেক দিন আগে। মূল গল্পের ভাবানুবাদ- অনেক দিন আগের কথা; তখন কচ্ছপ দ্বীপের বুকে হামাগুড়ি দেয়া, হেঁটে চলা, উড়ে বেড়ানো এবং বুকে ভর দিয়ে চলা সকল প্রাণী শান্তিপূর্ণভাবে একসাথে বসবাস করত। যারা সাঁতার কাটে তারা সাগরের গভরি নীল জলরাশিতে সাঁতার কেটে বেড়াত। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। সৃষ্টিকর্তাও সৃষ্টির মাঝে এমন ঐক্যতান দেখে হাসলেন।

এরপর গল্পে আগমন ঘটে (Wee-sak-ee-jack) উইস্যাকইজ্যাক নামক রহস্যময় চরিত্রের। ধারনা করা হয় নেহিয়াওয়াক জনপদের মাঝে যতগুলো গল্প প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী গল্প যার সম্পর্কে, সে এই উইস্যাকইজ্যাক। তার কোন লিঙ্গভেদ নেই। গল্পে মাঝে প্রায়ই; তার ধূর্ততা ও কৌশলের কারণে তাকে সমস্যায় পড়তে দেখা যায়। তবে সে ছিল ভীষণ অলস। সৃষ্টিকর্তা তাকে প্রত্যেক প্রাণীর দেখভাল করার ও তাদের যত্ন নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার অলসতার কারণে সে তার দায়িত্বে অবহেলা করতে থাকে। একসময় সকল প্রাণীর মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির মধ্যেকার  পুরোনো সেই ঐক্যতান ধীরে ধীরে বিনষ্ট হয়। কচ্ছপ দ্বীপের প্রাণীরা একে অপরকে অসম্মান করতে শুরু করে। তারা মারামারি ও হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়। একে অপরের সাথে লড়াইয়ের মাত্রা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে কচ্ছপ দ্বীপ রক্তে লাল হয়ে যায়।

স্রষ্টা ভীষণ ক্ষু্দ্ধ হলেন। তিনি উইস্যাকইজ্যাক কে সতর্কবার্তা পাঠালেন যে, অবিলম্বে কচ্ছপ দ্বীপের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা চাই; স্রষ্টার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করা চাই। অন্যথায় উইস্যাকইজ্যাক- এর সকল ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হবে। পাশাপাশি জমি, বন, পাহাড় সবকিছু কেড়ে নেয়া হবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার এসব কথা সে মোটেই বিশ্বাস করলো না। অন্যদিকে একে অপরের সাথে লড়াইয়ের মাত্রা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে কচ্ছপ দ্বীপ রক্তে লাল হয়ে যায়।

সৃষ্টিকর্তা সবকিছু কেড়ে নিয়ে, নতুন করে সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কচ্ছপ দ্বীপের মাটি থেকে রক্তের দাগ মুছে দিতে ও সবকিছু ধুয়ে দিতে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হলো। প্রবল বর্ষণের কারণে বন্যা পানি তেড়ে আসতে থাকল। বন্যা অবশ্য সাাঁতার কাটা প্রাণীদের কোনো ক্ষতি করলো না। জলের প্রকোপে, অন্য সব প্রাণী ডুবে গেল। কানায় কানায় জলে পরিপূর্ণ পৃথিবীতে চারজন মাত্র বেঁচে রইল।

উইস্যাকইজ্যাক, ধারালো দাঁতওয়ালা লোমশ বীভার (Beaver), অটার (Otter) বা জলনকুল ও মাস্ক্রাট (Muskrat)। (সবগুলো প্রাণীর বাংলা নাম জানা নেই। কারো জানা থাকলে সাহায্য করতে পারেন) এরা সবাই সমুদ্রের মাঝখানে একটি বড় গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে ভেসে রইল। অসহায় উইস্যাকইজ্যাক তার মূর্খতা এবং অলসতার কথা ভেবে কান্না করতে শুরু করলো। সেই সব হারিয়ে যাওয়া জীবনের কথা ভেবে সে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। বীভার, অটার ও মাস্ক্রাট; তার এ দুরবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করলো- আমরা কিভাবে সাহায্য করতে পারি? তাদের স্নেহশীলতায়, উইস্যাকইজ্যাক পুনরায় সাহস ফিরে পেলো। সে ভাবলো যে; জলের নীচে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো পৃথিবীর মাটির সামান্য অংশ যদি পাওয়া যায়, তাহলে তার অবশিষ্ট ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বসবাস করার জন্য হয়তো একটি ছোট্ট দ্বীপ তৈরি করা যাবে। সৌভাগবশত বীভার, অটার ও মাস্ক্রাট; এরা তিনজনই ছিল অবিশ্বাস্য রকমের ভালো সাঁতারু। উইস্যাকইজ্যাক প্রথমে অটার এর কাছে সাহায্য চাইলো- অতল সমুদ্রের গভীরে ডুব দিয়ে; হারিয়ে যাওয়া পৃথিবী থেকে মাটির সামান্য অংশ তুলে আনতে হবে। অটার ডুব দিয়ে জলের গভীরে হারিয়ে গেলো। কিন্তু অটার দম ফুরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে খালি হাতে ফিরে এলো। উইস্যাকইজ্যাক এবার বীভারের কাছে সাহায্য চাইলো। সাঁতার কাটতে সহায়ক; চ্যাপ্টা আর শক্তিশালী লেজ ছিল বীভারের কাছে। বীভার জলের গভীরে ডুব দিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য হারিয়ে গেলো। শূন্যহাতে যখন সে ফিরে এলো, তখন তার প্রায় প্রাণহীন শরীর। আশাহত উইস্যাকইজ্যাক এবার পুরোপুরি ভেঙ্গে পরলো। এবার মাস্ক্রাট নিজে থেকেই বললো- আমি যাবো। তার কথা শুনে অটার ও বীভার উন্মাদের মতো হাসতে থাকলো। কারণ মাস্ক্রাট; আকারে তাদের দুইজনের তুলনায় নিতান্তই ছোটখাটো।

উইস্যাকইজ্যাক এবার মাস্ক্রাট কে তুলে নিয়ে বললো- তুমি সত্যিই কি পারবে? মাস্ক্রাট সোজাসাপ্টা জবাব দিলো- দেখ আমি কি করতে পারি। বলেই সে ডুব দিলো। প্রথমবার অবশ্য সে খালি হাতে ফিরে এলো। দ্বিতীয়বার যখন সে তার প্রায় প্রাণহীন শরীরটা নিয়ে ফিরে এলো; তখন তার হাতের মুঠির ভেতরে উইস্যাকইজ্যাক পেলো খুব সামান্য পরিমাণ মাটির কণা। তৎক্ষণাত তার অবশিষ্ট ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে উইস্যাকইজ্যাক মাটির কণার উপর ফুৎকার দিলো। নিমিষেই এক বিন্দু মাটির কণা প্রসারিত হতে হতে একটি দ্বীপ তৈরি হলো।

Coursera.org ওয়েবসাইটে Indigenous Canada নামক কোর্সটি নামমাত্র মূল্যে সনদপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আবার বিনামূল্যে ক্লাস শেষ করার সুবিধাও রয়েছে। টাকার বিনিময় ব্যতীত শিক্ষা; এই বাজারে এমন সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই জগৎ, সংসার, মহামারী- সব কিছু উপেক্ষা করে; মহা উৎসাহ নিয়ে ক্লাস শুরু করেছিলাম। কিন্তু সাধা জিনিসের দাম আধা। কোর্স শেষ করার ক্ষেত্রে আমার অবস্থাও ঠিক একই রকম।

তথ্যনির্দেশ

Indigenous Canada, Alberta University/Coursera.org

প্রত্নতত্ত্বের প্রথম পাঠ- ২য় পর্ব

যে কোন বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা অর্জনের ক্ষেত্রে, বিষয়বস্তুটির ধারাবাহিক ইতিহাসের কিছুটা গুরুত্ব থাকে। তবে প্রত্নচর্চার ক্ষেত্রে তা ভিন্নভাবে কাজ করে।

Continue reading

প্রত্নতত্ত্বের প্রথম পাঠ- ১ম পর্ব

প্রত্নতত্ত্ব পুরোনো জিনিস সম্পর্কে নতুন তথ্য সন্ধানের একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। মানুষের ফেলে আসা বস্তুগত উপাদান অধ্যয়নের মাধ্যমে অতীত মানুষের আচরণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করাই প্রত্নতত্ত্ব।

Continue reading

জুয়াড়ির গান

Reading Time: 3 minutes
জুয়াড়ির গান: ঋগ্বেদের মানুষ

জুয়াড়ির গান, ঋগ্বেদের একটি শ্লোক। ঋগ্বেদ হচ্ছে ধর্মীয় আচার, অনুশাসনের সংকলন। দেবতা ও ঋষিদের দার্শনিক দূরকল্পনা । তাদের পাশাপাশি টিকে যাওয়া একজন সাধারণ মানুষের গল্প পাওয়া যাবে ‘জুয়াড়ির গান’ শ্লোকে। লিপিবদ্ধ হবার অনেক আগে থেকেই শ্লোকগুলো প্রচলিত ছিল। শুধুমাত্র গুরু থেকে শিষ্যের কাছে মৌখিকভাবে তা প্রচার করা হত। জুয়াড়ির গান; তেমনি প্রচলিত একটি শ্লোক। পুরোহিতদের যজ্ঞের বিবরণের বাইরে নিতান্তই সাধারণ এক জুয়াড়ির কথা পাওয়া যাবে এ শ্লোকে।

By Amanda Jones. Unsplash

জুয়াড়ির গান- মূল লেখাটি ঋগ্বেদ থেকে অনুবাদ করা হয়েছে । পাশার ঘুঁটি কিভাবে জুয়াড়ির হৃদয়কে ছাড়খাড় করে দেয় তার বিবরণ পাওয়া যাবে এ শ্লোকে ।

তারা হস্তহীন, তাদের সেবার কাজে মানুষকেই হাত লাগাতে হয় ।
ছকের ওপর ঢালাই করা, যাদু কাঠ কয়লার মতো, যদিও তারা নিজেরা শীতল, তবু তারা হৃদয়কে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় ।

ঋগ্বেদ দশম, ৩৪ । সংকলন ১.৪ । বৈদিক সভ্যতা; ইরফান হাবিব ।

ঋগ্বেদে সৃষ্টি সম্পর্কিত যে শ্লোক রয়েছে তার সাথেও এর পার্থক্য এখানেই । এখানে জুয়াড়ির স্বভাব, নিঃসঙ্গতা আলোচনার প্রধান বিষয় । জুয়াড়ির গান- তখনকার সামাজিক অবস্থান সম্পর্কেও সাধারণ বিবরণ তুলে ধরে। শ্লোকটি নিম্নরূপ –

জুয়াড়ির গান


আমার প্রাণাধিক প্রিয় পাশার ঘুঁটি, মুদ্রাভানের আপন

সুরার গাঢ় খরার চেয়েও কোনোদিন সে নিদ্রালস হয় না ।

সে কখনো আমাকে বিরক্ত করে না, কিংবা আমার ওপর রাগ করে না,

বরং আমার বন্ধুদের ওপর, আমার ওপর কৃপা বর্ষণ করে ।
আমার পাশার ঘুটিঁর কারণে, যার একটি বিন্দুই চূড়ান্ত,

তার জন্যে আমার অনুগতা স্ত্রীকে ছেড়ে এসেছি আমি ।

আমার স্ত্রী আমাকে একলা ধরে রেখেছে, তার মা আমাকে ঘৃণা করে;

হতচ্ছাড়া মানুষটি তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য কাউকে খুঁজে পায় না ।
মহামূল্যবান ঘোড়া যখন বৃদ্ধ আর দুর্বল হয়ে যায় তখন যেমন সে মূল্যহীন

তেমনি জুয়ায় আমি কোনো লাভের মুখ দেখি না ।

জুয়াড়ি যখন কোনো পরিচারিকাকে দেখে, দেখে অন্যের স্ত্রীকে, কারোর সুশৃঙ্খল গৃহস্থালী, সে বিষণ্ণ হয় ।
খুব ভোরে সে তার বাদামী ঘোড়া জোয়ালে জুতে নেয় এবং যখন আগুন ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তখন সে পরিত্যক্ত অবস্থায় ডুবে যায় ।

ঋগ্বেদ দশম, ৩৪ । সংকলন ১.৪ । বৈদিক সভ্যতা; ইরফান হাবিব । পৃ:৩৩। অনুবাদ: বিজয় কুমার ঠাকুর ।

বৈদিক সভ্যতা ও ঋগ্বেদ

ঋগ্বেদ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম সাহিত্যিক সুত্র । শুরুতে এর কোনো লিখিত রূপ ছিল না । প্রাচীনকালে ঋষি, মুনিরা গুরু হতে শিষ্যের কাছে মৌখিকভাবে এ শিক্ষা পৌছে দিতেন । ঋষি বা পুরোহিতদের কাছে যা ছিল অত্যন্ত পবিত্র । বলা হয় এর প্রতিটি পঙক্তি সম্পর্কে ঋষিরা শ্রুত অথবা দৃষ্ট হয়েছেন । তাই ঋগ্বেদ শ্রুতি সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত । ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব- চারটি বেদের প্রথমটির নাম ঋগ্বেদ সংহিতা। বেদের প্রাথমিক পাঠ বা সংকলনকে সংহিতা বলে । প্রতিটি সংহিতার সাথে যুক্ত থাকে একটি ব্রাহ্মণ । যা মূলত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের নির্দেশনা সংকলন । প্রতিটি ব্রাহ্মণে একটি আরণ্যক ও একটি উপনিষদ থাকে ।

জুয়াড়ির গান- ঋগ্বেদ

পুণ্ড্রনগর গড়ে তোলা ‘পুণ্ড্র’ জাতির উল্লেখ পাওয়া যায় এমন একটি সংহিতার নাম ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ । এ সম্পর্কে ‘হারানো নদী হারানো জনপদ’ লেখাটিতে সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে । তাছাড়া ‘বঙ্গ’ জাতির সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হয়েছে ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ সংহিতায় । এছাড়াও রয়েছে স্মৃতি সাহিত্য । স্মৃতি শব্দের সাথে ‘স্মর’ এর সম্পর্ক রয়েছে; যার অর্থ স্মৃতিচারণ করা । মহাভারত, রামায়ণ, অর্থশাস্ত্র, বিভিন্ন পুরাণ ইত্যাদি স্মৃতি সাহিত্যের অন্তর্গত । তবে পুরাণ অনুযায়ী, ‘স্মৃতি’ হচ্ছে দেবতা ধর্ম ও মেধা’র মেয়ে । স্মৃতি; নির্দিষ্ট লিপিকর দ্বারা রচিত । স্মৃতিকে সাধারণত মৌলিক কাজ হিসেবে ধরা হয় না এবং শ্রুতির তুলনায় কম নির্ভরযোগ্য বলে মনে করা হয় । ধর্মীয় আচার, অরণ্যবাসী ঋষিদের জন্য উপদেশ ও দার্শনিক নির্দেশনার মাঝে জুয়াড়ির গান- শ্লোকটি নিসন্দেহে একটি অনবদ্য শিল্পকর্ম ।

তথ্যনির্দেশ

বৈদিক সভ্যতা; ইরফান হাবিব । পৃ:৩৩। অনুবাদ: বিজয় কুমার ঠাকুর ।

ঋগ্বেদ দশম, ৩৪ । সংকলন ১.৪ । (গ্রিফিতের অনুবাদ, সামান্য পরিবর্দ্ধিত)

শ্রুতি শব্দটিকে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়, বিশেষ করে ছান্দোগ্যোপনিষদ্‌ এর ৭.১৩ অনুচ্ছেদে । স্মৃতি সাহিত্য হচ্ছে বিভিন্ন গ্রন্থের সংকলন । মহাভারত ও রামায়ণ, ধর্মসূত্র এবং ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, বিভিন্ন পুরাণ, কাব্য ইত্যাদি ।

জুয়াড়ির গান by নির্ঝর মাহমুদ is licensed under CC BY-NC-SA 4.0

জুয়াড়ির গান সম্পূর্ণ কবিতাটি পাওয়া যাবে এইখানেDownload