‘নৃ’ অর্থ মানুষ

Reading Time: 5 minutes

’নৃ‘ অর্থ মানুষ। Anthropology শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হলো ‘নৃবিজ্ঞান’। অর্থাৎ নৃবিজ্ঞান হচ্ছে মানুষ বিষয়ক বিজ্ঞান। মানুষের ডিএনএ থেকে শুরু করে তার মুখের ভাষা পর্যন্ত প্রায় সবকিছু নৃবিজ্ঞানে আলোচনা করা হয়। যেমন- Biological Anthropology (Or Physical Anthropology) বা জীবতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানে জীব বা প্রাণী হিসেবে মানব প্রজাতিকে অধ্যয়ন করা হয়। নৃবিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা Archaeology বা প্রত্নতত্ত্ব। বর্তমানে যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করা হয় তার অধিকাংশই নৃবিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া Linguistics বা ভাষাবিদ্যা এবং Cultural Anthropology বা সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞান, পৃথক দুটি শাখা হিসেবে নৃবিজ্ঞানে অধ্যয়ন করা হয়।

(এই পর্বে শুধুমাত্র Archaeology বা প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে লেখা হয়েছে। পরবর্তী পর্বে নৃবিজ্ঞানের অনান্য শাখাগুলি নিয়ে বিস্তারিত লেখা হবে।)

প্রত্নতত্ত্ব

অনেকের কাছেই প্রত্নতত্ত্ব বা প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান মানে, উত্তেজনায় ভরপুর নতুন কোনো অভিযান। কারো কারো মতে তা ভাবপ্রবণ মানুষের কৌতুহল মাত্র। কিংবা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান। অধ্যাপক ন্যান্সি ম্যারী হোয়াইট অবশ্য তিনটি মতামতকেই সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। সহজ ভাষায় প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে লেখা তার বইয়ের নামটিও বেশ মজার- “Archaeology For Dummies” ।

Dummy বা ডামি হল মানুষের কৃত্রিম প্রতিকৃতি। বাংলায় যার ভাবার্থ হিসেবে ভাবলেশহীন, বোকা, নির্বোধ, আহাম্মক, মূর্খ, গবেট ও জড়বুদ্ধি এই শব্দগুলো পাওয়া যায়। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে; যে কোনো বিষয়ে একাধিক প্রশ্ন করা হলে সাধারণত তুচ্ছার্থে এই শব্দগুলো উপাধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেইসব বোকা মানুষের জন্য লেখা এই বই।

Archaeology for Dummies -এর যথাযথ অনুবাদের কাজটি নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের জন্য রেখে আমরা ‘নির্বোধের প্রত্নচর্চা’ ভাবানুবাদটি ব্যবহার করছি। প্রত্নতত্ত্বের খুটিনাটি নিয়ে জানার আগে আমরা লেখকের কথা কিছুটা জেনে নেই।

ন্যান্সি ম্যারী হোয়াইট

অধ্যাপক ন্যান্সি ম্যারী হোয়াইট একজন পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক। ফ্লোরিডা প্রত্নতত্ত্ব, দক্ষিণ-পূর্ব মার্কিন প্রত্নতত্ত্ব, উত্তর আমেরিকা আদিবাসী পরিচিতি, দক্ষিণ আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ব, ইউরোপীয় প্রাগৈতিহাসিক নৃতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব পরিচিতি প্রভৃতি বিষয়ে তিনি পাঠদান করেন।

তার ভাষ্যমতে- যখন আমরা অজানাকে জানার জন্য চেষ্টা করি তখনই সেখানে নতুন অভিযানের আনন্দ পাওয়া যায়। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান; অতীতকালের বিভিন্ন নিদর্শন উন্মোচনের পাশাপাশি, মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকার লড়াই করেছে তার নাটকীয় সব গল্প আমাদের কাছে উপস্থাপন করে। এসব গল্প বর্তমান কালের মানুষের জন্য শিক্ষা হতে পারে। প্রত্নতত্ত্বের প্রকৃতি নিয়ে ভুল ধারণার ছড়াছড়ি প্রায় সবখানে। তাই এই অধ্যায়ে প্রত্নতত্ত্বের সঙ্গা নিয়ে আলোচনা করবো। সত্যিকার অর্থে প্রত্নচর্চা, একজন গোয়েন্দার রহস্য অনুসন্ধান ও সমাধান করার মতই রোমাঞ্চকর।

প্রত্নতত্ত্বের সহজ সংজ্ঞা

প্রত্নতত্ত্ব পুরোনো জিনিস সম্পর্কে নতুন তথ্য সন্ধানের একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া। প্রত্নতত্ত্ব; মানুষের ফেলে আসা বস্তুগত উপাদানগুলো অধ্যয়ন করার মাধ্যমে অতীত মানুষের আচরণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে। বস্তুগত উপাদান বলতে যে কোনো দৃশ্যমান বস্তু যেমন- মানুষের বসতির অবশিষ্টাংশ, বীজ বা শস্যদানা, অলংকারের অংশবিশেষ, কড়ি এমনকি মিশরের পিরামিডও এর অন্তর্ভুক্ত। 

প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞান মানুষের সাথে সম্পর্কিত। প্রত্নতত্ত্ব অতীতকালের মানুষের রেখে যাওয়া বিভিন্ন বস্তুগত উপাদান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। যেখানেই মানুষের পদচিহ্ন পড়েছে সেখান থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের গল্প পাওয়া যায়। এসব গল্প মূলত মানুষেরই গল্প। বলা হয়, প্রত্যেক মানুষই কিছু না কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করে থাকে। তার নিজের সাথে অবিচ্ছেদ্য এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টায় মত্ত থাকে।

প্রত্নতত্ত্বের লক্ষ্য: মানুষকে বুঝতে পারা

প্রত্নতত্ত্বের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে-

১. ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের, বিভিন্ন স্থানের মানুষের অতীতকে অধ্যয়ন করা।

২. অতীতকালের মানুষের আচরণ ও জীবনযাপন পদ্ধতি পুনর্গঠন করা।

৩. প্রাচীনকালের সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা (সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়) বুঝতে পারা ও কীভাবে তা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়েছে তা অনুসন্ধান করা।

৪. ভঙ্গুর প্রত্নবস্তু সংরক্ষণ করা এবং ঐতিহ্যকে বর্তমান মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করা।

৫. অতীতকালের এই গল্পগুলো সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে আসা; যেন তারা শিক্ষা বা ব্যবহারিক কাজে, বিনোদনের জন্য হলেও তা উপভোগ করতে পারে।

পদ্ধতি: গোয়েন্দাগিরি করা

রহস্য অনুসন্ধান ও সমাধান করার জন্য একজন গোয়েন্দা যে সকল পদ্ধতি ব্যবহার করেন; একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের কাজ অনেকাংশে একই রকম।

১. প্রত্নবস্তু বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অথবা প্রত্নস্থল; সাবধানে পরিমাপ করা, প্রমাণ সংগ্রহ করা, তথ্য সংরক্ষণ করা এবং ছবি তোলা (ঠিক যেন অপরাধী সনাক্তকরণে ঘটনাস্থলে একজন বিচক্ষণ গোয়েন্দার কর্মকাণ্ড)।

২. প্রত্নস্থলে তথ্য সংরক্ষণ অত্যন্ত শ্রমসাধ্য কাজ। তাই যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে ও বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে তথ্য সংরক্ষণ করা।

৩. প্রত্নস্থলে কাজ শুরুর আগে সে স্থানের পটভূমি, সেখানকার মানুষ ও তার ইতিহাস, সময়কাল সম্পর্কে যথাসম্ভব তথ্য যোগাড় করা।

৪. প্রত্নস্থলটির ক্ষেত্রে কি ঘটেছিলো জানতে আশেপাশের মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়া।

৫. প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ জোগাড়ের ক্ষেত্রে পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নের মতো অনান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সহযোগিতা নেয়া।

৬. প্রত্নস্থলে কি ঘটেছিলো তা জানতে সমস্ত তথ্য সংকলন করা।

৭. কাজ শুরু করা। প্রাপ্ত তথ্য যাচাই বাছাই করা ও প্রশ্ন করা। অনান্য বিশেষজ্ঞদের কাজের সাথে যুক্ত করা।

৮. সিদ্ধান্তে আসার আগ পর্যন্ত অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া।

আমরা সবাই প্রত্নতাত্ত্বিক

আবার পুরানো কথায় ফেরা যাক। আমরা আগেই জেনেছি যে, Dummy অর্থাৎ মানুষের কৃত্রিম প্রতিকৃতি। বাংলায় যার ভাবার্থ হিসেবে ভাবলেশহীন, বোকা, নির্বোধ, আহাম্মক, মূর্খ, গবেট ও জড়বুদ্ধি এই শব্দগুলো পাওয়া যায়। সেইসব বোকা মানুষের উদ্দেশ্যেই লেখক বলছেন যে- প্রত্যেকেই কিছু না কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ করে প্রায় প্রতিদিনই। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞান আমাদের উপলব্ধি করতে সহযোগিতা করে, যে হাজার বছর আগে বেঁচে থাকা মানুষের সাথে আমাদের জীবনের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা রয়েছে। এই হাজার বছরে মানুষের খুব সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা, ভয় এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের উদ্বেগ পূর্বের যুগের মানুষের থেকে এতটা আলাদা নয়।

প্রত্নতত্ত্বের প্রকৃতি ও কয়েকটি সংজ্ঞা

বিজ্ঞানের অনান্য শাখার মতো প্রত্নতত্ত্বেরও নিজস্ব কিছু ভাষা রয়েছে। যে কোন আলোচনা শুরুর পূর্বে তাই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত হওয়া দরকার।

Archaeology বা প্রত্নতত্ত্ব

আমরা এই শব্দটির সাথে পরিচিত হয়েছি। তবে অনেক সময় Archaeology ও Archeology শব্দ দুটির বানান পার্থক্য দেখে আমরা দ্বিধায় পড়ে যাই। দুটি শব্দেরই বাংলা প্রতিশব্দ প্রত্নতত্ত্ব। সাধারনত সম্পাদক বা প্রকাশকদের মাঝে Archaeology শব্দটি বেশী জনপ্রিয়।

Artifact বা নিদর্শন

মানুষের তৈরী যে কোন কিছুকেই প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় Artifact বা নিদর্শন বলে। প্রত্নতত্ত্বের ভাষায়, মানবসৃষ্ট যে কোন দৃশ্যমান বস্তু যা পরিমাপ করা যায় ও যা থেকে তথ্য পুনরুদ্ধার করা যায় তাই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এমনকি মানুষের লেখা গান, কবিতা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। প্রস্তর যুগে পাথরের হাতিয়ার তৈরীর জন্য কিছু পাথর হাতুড়ির মত ব্যবহার করা হতো। এক্ষেত্রে হাতিয়ার ও ব্যবহৃত পাথর খণ্ড দুটোই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রত্নস্থল থেকে সংগৃহিত তথ্য, মানচিত্র ও ছবি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হবে।

Ecofact বা জৈব নিদর্শন

ইকোফ্যাক্ট শব্দটি যা প্রত্নতাত্ত্বিকেরা আবিষ্কার করেছেন। প্রাচীনকালে কোন রকম পরিবর্তন ছাড়াই প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান মানুষ তার নিত্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করতো। এসব নিদর্শনকে বলা হয় জৈব নিদর্শন। যেমন- যে কোন প্রাণীর হাড়। অনেক সময় তা হাতুড়ী হিসেবে ব্যবহৃত হত কোন পরিবর্তন ছাড়াই। কিন্তু পরিবর্তিত আকারে ব্যবহার করা হলে তাকে বলা হয় নিদর্শন। যেমন- প্রাচীন কালে মানুষের ফেলে যাওয়া আবর্জনা মাটির সাথে মিশে ফসফেট তৈরী করে। প্রত্নস্থলে ফসফেটের উপস্থিতি অনেক সময় জৈব নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু প্রাণীর হাড় থেকে তৈরী করা বাঁশিকে নিদর্শন হিসেবে ধরা হয়।

Site বা প্রত্নস্থল

প্রত্নস্থল বলতে এমন জায়গা বোঝায় যেখানে মানব বসতি গড়ে উঠেছিলো বা অনান্য কর্মকাণ্ড ছিল এবং যেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে সম্ভাব্য প্রত্নস্থলের সন্ধানে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ করা হয়।

Components & Boundaries বা উপাদান ও সীমানা

বিভিন্ন প্রত্নস্থলে দেখা যায় যে, ইতিমধ্যে ব্যবহৃত স্থানটিতে পূর্ববর্তী কালের মানুষেরা বিভিন্ন চিহ্ন রেখে যায়। প্রত্নতত্ত্বের ভাষায়, প্রত্নস্থলে একটি উপাদান যুক্ত করা হলো। অনেক সময় একাধিক উপাদানের চিহ্ন বিভিন্ন প্রত্নস্থলে পাওয়া যায়। মূল প্রত্নস্থলে, পাশাপাশি কয়েক হাজার বছর পুরোনো সাংস্কৃতিক উপাদান পাওয়া সম্ভব। অন্যদিকে প্রত্নস্থলের সীমনা নির্ধারণ করা বেশ দুরূহ ব্যাপার। কোনও প্রত্নস্থলের সীমানা অনুসন্ধান করা একই সময়ে জটিল এবং প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ব্যাতীত প্রায় অসম্ভব।

কিভাবে প্রত্নস্থল গঠিত হয়?

প্রত্নস্থল গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে মানুষ, প্রকৃতি ও সময়। প্রত্নস্থল গঠন প্রক্রিয়াকে প্রধানত দুই ভাগে করা যায়।

Cultural Process বা সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া এবং Natural Process বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।

Cultural Process বা সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া

সহজ ভাষায়; প্রত্নস্থল গঠনের সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া হল মানুষ তার জীবন যাপনের জন্য যা কিছুই করে তা প্রত্নস্থলটিতে বস্তুগত উপাদান, নিদর্শন বা প্রমাণ হিসেবে যুক্ত হতে পারে। যেমন-

১। নিদর্শন তৈরীঃ আমরা আগেই জেনেছি, প্রস্তর যুগে পাথরের হাতিয়ার তৈরীর জন্য কিছু পাথর হাতুড়ির মত ব্যবহার করা হতো। এক্ষেত্রে প্রত্নস্থলে প্রাপ্ত হাতিয়ার ও ব্যবহৃত পাথর খণ্ড দুটোই সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার সংযুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এর মাধ্যমে প্রত্নস্থলটির সীমানা অনুসন্ধান করা সম্ভব। প্রত্নস্থলটিতে পাশাপাশি কয়েক হাজার বছর পূর্ববর্তী বা পরবর্তী সাংস্কৃতিক উপাদান পাওয়া অসম্ভব নয়।

২। ক্রিয়াকলাপের প্রমাণ রেখে যাওয়াঃ মানুষ যখন কোন জায়গায় বসতি স্থাপন করে ও পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান ব্যবহার করে তখন সেখানে ব্যবহৃত এসব উপাদানের অবশেষ রেখে যায়। মানুষ দীর্ঘকাল থেকে পুনঃব্যবহার ও মেরামতের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তুগত উপাদান ব্যবহার করে আসছে। এসব ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে মানুষ বিভিন্ন চিহ্ন বা ধ্বংসাবশেষ রেখে যায়।

৩। বাতিলকৃত উপাদানঃ জঞ্জালতৈরী করা মানুষের পুরোনো স্বভাব। হাজার বছর পুরোনো মানুষের বাতিলকৃত বিভিন্ন উপাদানও প্রত্নস্থল গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন আমাদের তৈরী করা পলিথিন কয়েক লক্ষ বছর পরও প্রত্নতাত্ত্বিকদের বিরক্তির উদ্রেক ঘটাবে।

৪। ভুলে যাওয়া মূল্যবান বস্তুঃ গোপনে মজুদ করে রাখা বা অতিরিক্ত সম্পদ লুকিয়ে রাখাও মানুষের বহু পুরোনো স্বভাব। অনেক সময় মানুষ লুকিয়ে রাখা এসব সম্পদ সম্পর্কে ভুলে যায়। প্রত্নস্থল থেকে প্রাপ্ত মজুদকৃত এসব উপাদান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়।

Natural Process বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া

প্রকৃতিও বিভিন্ন প্রত্নতাত্তিক উপাদান ও প্রত্নস্থল গঠন করে থাকে। যেমন বাতাস, মাধ্যাকর্ষণ, বৃষ্টিপাত, ঝড়, খরা, আগ্নেয়গিরি( পম্পেই শহরজুড়ে আগ্নেয় ছাই) এবং স্থানীয় আবহাওয়া বা জলবায়ু প্রত্নস্থল গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের প্রত্নস্থল গঠনে নদী, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, পলি গঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া জৈবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন উপাদানে ক্ষয়সাধন করে।

রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় মধ্যে আবহাওয়ার কারণে পাথরের ক্ষয় বা ভাঙ্গন, লোহায় মরিচা পড়া(লোহার তৈরী যে কোন নিদর্শনের প্রাকৃতিক পরিবর্তন), মৃত ও পচনশীল গাছপালা ও মৃত প্রাণীর মাটিতে অ্যাসিড বা অম্লতা তৈরীও প্রত্নস্থল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো ভাবতে হলে এই সমস্ত প্রক্রিয়া, তার প্রভাব ও এদের মধ্যে পার্থক্য নিশ্চিত করতে হবে।

তথ্যনির্দেশ

১। Archaeology: Seeing Past People Today, Archaeology for Dummies by Nancy Marie White.


This work is licensed under a Creative Commons Attribution 4.0 International License.

কচ্ছপ দ্বীপের উপাখ্যান

Reading Time: 4 minutes

কিন্তু গল্প বলা তো থেমে থাকতে পারে না; লিখিত ইতিহাসে যেইসব গল্প পাওয়া যায় না। কানাডার আদিবাসী মানুষেরা সেইসব গল্প বলা’কে তাদের জীবন যাপনের পথ নির্দেশনা বলে বিশ্বাস করতো। প্রধানত দুই ধরনের মৌখিক গল্পের প্রচলন ছিল। এক ধরনের গল্পে- ব্যাক্তির অভিজ্ঞতা, নির্দিষ্ট কোনো স্থানের নামকরণের কাহিনী, পর্যবেক্ষণ বা উপলদ্ধি মূলক বিবরণ পাওয়া যায়। এধরনের গল্পগুলো সময়ের সাথে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও প্রাসঙ্গিকতার বিচারে তা পরিবর্তিত হতে থাকে। সমাজের সকল স্তরেই এসব উপাখ্যানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শিক্ষণীয় এসব গল্পের মাধ্যমে; নিজস্ব ইতিহাস ও পরিবেশ সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি তৈরী হতো। গল্প বলার প্রচলন; তাদের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। দ্বিতীয় ধরনটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত যা সাধারনত সৃষ্টির গল্প, কিংবদন্তি বা পৌরাণিক গল্প হিসেবে পরিচিত। এইসব গল্পের আত্মিক দিকটি সময়ের সাথে অপরিবর্তিত থেকে যায়।

কচ্ছপ দ্বীপের গল্পকেও সৃষ্টির গল্প বলা যায়; যার কোনো লিখিত রূপ ছিল না। মৌখিকভাবে এ গল্প বলা হতো। গল্প শেষ করতে পুরো এক দিন কখনোই যথেষ্ঠ সময় ছিলো না। কখোনো গল্প শেষ করতে এক সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। আদিবাসী সম্প্রদায় ভেদে কচ্ছপ দ্বীপের গল্পে নানা রকম পরিবর্তন দেখা যায়। তবে বেশিরভাগ গল্পেই জীবন এবং পৃথিবীর রূপক হিসেবে কচ্ছপের ব্যবহার হয়েছে। আমাদের মূল লেখা নেহিয়াওয়াক জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত গল্প নিয়ে। প্রাসঙ্গিক আলোচনা হিসেবে ওজিবওয়ে এবং হডনেসোনী জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত গল্পের সংস্করণ কিছুটা থাকবে।

Nehiyawak বা নেহিয়াওয়াক

নেহিয়াওয়াক শব্দের অর্থ যারা একই ভাষায় কথা বলে। সাধারনত নেহিয়াওয়াক বলতে ‘ক্রি’ জনগোষ্ঠীকে বোঝায়। তাদের কচ্ছপ দ্বীপের গল্প শুরু হয় ‘কায়াস’ শব্দটি দিয়ে, বাংলায় যার অর্থ- অনেক দিন আগে। মূল গল্পের ভাবানুবাদ- অনেক দিন আগের কথা; তখন কচ্ছপ দ্বীপের বুকে হামাগুড়ি দেয়া, হেঁটে চলা, উড়ে বেড়ানো এবং বুকে ভর দিয়ে চলা সকল প্রাণী শান্তিপূর্ণভাবে একসাথে বসবাস করত। যারা সাঁতার কাটে তারা সাগরের গভরি নীল জলরাশিতে সাঁতার কেটে বেড়াত। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। সৃষ্টিকর্তাও সৃষ্টির মাঝে এমন ঐক্যতান দেখে হাসলেন।

এরপর গল্পে আগমন ঘটে (Wee-sak-ee-jack) উইস্যাকইজ্যাক নামক রহস্যময় চরিত্রের। ধারনা করা হয় নেহিয়াওয়াক জনপদের মাঝে যতগুলো গল্প প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী গল্প যার সম্পর্কে, সে এই উইস্যাকইজ্যাক। তার কোন লিঙ্গভেদ নেই। গল্পে মাঝে প্রায়ই; তার ধূর্ততা ও কৌশলের কারণে তাকে সমস্যায় পড়তে দেখা যায়। তবে সে ছিল ভীষণ অলস। সৃষ্টিকর্তা তাকে প্রত্যেক প্রাণীর দেখভাল করার ও তাদের যত্ন নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার অলসতার কারণে সে তার দায়িত্বে অবহেলা করতে থাকে। একসময় সকল প্রাণীর মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির মধ্যেকার  পুরোনো সেই ঐক্যতান ধীরে ধীরে বিনষ্ট হয়। কচ্ছপ দ্বীপের প্রাণীরা একে অপরকে অসম্মান করতে শুরু করে। তারা মারামারি ও হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়। একে অপরের সাথে লড়াইয়ের মাত্রা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে কচ্ছপ দ্বীপ রক্তে লাল হয়ে যায়।

স্রষ্টা ভীষণ ক্ষু্দ্ধ হলেন। তিনি উইস্যাকইজ্যাক কে সতর্কবার্তা পাঠালেন যে, অবিলম্বে কচ্ছপ দ্বীপের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা চাই; স্রষ্টার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করা চাই। অন্যথায় উইস্যাকইজ্যাক- এর সকল ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হবে। পাশাপাশি জমি, বন, পাহাড় সবকিছু কেড়ে নেয়া হবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার এসব কথা সে মোটেই বিশ্বাস করলো না। অন্যদিকে একে অপরের সাথে লড়াইয়ের মাত্রা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে কচ্ছপ দ্বীপ রক্তে লাল হয়ে যায়।

সৃষ্টিকর্তা সবকিছু কেড়ে নিয়ে, নতুন করে সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কচ্ছপ দ্বীপের মাটি থেকে রক্তের দাগ মুছে দিতে ও সবকিছু ধুয়ে দিতে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হলো। প্রবল বর্ষণের কারণে বন্যা পানি তেড়ে আসতে থাকল। বন্যা অবশ্য সাাঁতার কাটা প্রাণীদের কোনো ক্ষতি করলো না। জলের প্রকোপে, অন্য সব প্রাণী ডুবে গেল। কানায় কানায় জলে পরিপূর্ণ পৃথিবীতে চারজন মাত্র বেঁচে রইল।

উইস্যাকইজ্যাক, ধারালো দাঁতওয়ালা লোমশ বীভার (Beaver), অটার (Otter) বা জলনকুল ও মাস্ক্রাট (Muskrat)। (সবগুলো প্রাণীর বাংলা নাম জানা নেই। কারো জানা থাকলে সাহায্য করতে পারেন) এরা সবাই সমুদ্রের মাঝখানে একটি বড় গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে ভেসে রইল। অসহায় উইস্যাকইজ্যাক তার মূর্খতা এবং অলসতার কথা ভেবে কান্না করতে শুরু করলো। সেই সব হারিয়ে যাওয়া জীবনের কথা ভেবে সে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। বীভার, অটার ও মাস্ক্রাট; তার এ দুরবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করলো- আমরা কিভাবে সাহায্য করতে পারি? তাদের স্নেহশীলতায়, উইস্যাকইজ্যাক পুনরায় সাহস ফিরে পেলো। সে ভাবলো যে; জলের নীচে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো পৃথিবীর মাটির সামান্য অংশ যদি পাওয়া যায়, তাহলে তার অবশিষ্ট ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বসবাস করার জন্য হয়তো একটি ছোট্ট দ্বীপ তৈরি করা যাবে। সৌভাগবশত বীভার, অটার ও মাস্ক্রাট; এরা তিনজনই ছিল অবিশ্বাস্য রকমের ভালো সাঁতারু। উইস্যাকইজ্যাক প্রথমে অটার এর কাছে সাহায্য চাইলো- অতল সমুদ্রের গভীরে ডুব দিয়ে; হারিয়ে যাওয়া পৃথিবী থেকে মাটির সামান্য অংশ তুলে আনতে হবে। অটার ডুব দিয়ে জলের গভীরে হারিয়ে গেলো। কিন্তু অটার দম ফুরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে খালি হাতে ফিরে এলো। উইস্যাকইজ্যাক এবার বীভারের কাছে সাহায্য চাইলো। সাঁতার কাটতে সহায়ক; চ্যাপ্টা আর শক্তিশালী লেজ ছিল বীভারের কাছে। বীভার জলের গভীরে ডুব দিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য হারিয়ে গেলো। শূন্যহাতে যখন সে ফিরে এলো, তখন তার প্রায় প্রাণহীন শরীর। আশাহত উইস্যাকইজ্যাক এবার পুরোপুরি ভেঙ্গে পরলো। এবার মাস্ক্রাট নিজে থেকেই বললো- আমি যাবো। তার কথা শুনে অটার ও বীভার উন্মাদের মতো হাসতে থাকলো। কারণ মাস্ক্রাট; আকারে তাদের দুইজনের তুলনায় নিতান্তই ছোটখাটো।

উইস্যাকইজ্যাক এবার মাস্ক্রাট কে তুলে নিয়ে বললো- তুমি সত্যিই কি পারবে? মাস্ক্রাট সোজাসাপ্টা জবাব দিলো- দেখ আমি কি করতে পারি। বলেই সে ডুব দিলো। প্রথমবার অবশ্য সে খালি হাতে ফিরে এলো। দ্বিতীয়বার যখন সে তার প্রায় প্রাণহীন শরীরটা নিয়ে ফিরে এলো; তখন তার হাতের মুঠির ভেতরে উইস্যাকইজ্যাক পেলো খুব সামান্য পরিমাণ মাটির কণা। তৎক্ষণাত তার অবশিষ্ট ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে উইস্যাকইজ্যাক মাটির কণার উপর ফুৎকার দিলো। নিমিষেই এক বিন্দু মাটির কণা প্রসারিত হতে হতে একটি দ্বীপ তৈরি হলো।

Coursera.org ওয়েবসাইটে Indigenous Canada নামক কোর্সটি নামমাত্র মূল্যে সনদপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আবার বিনামূল্যে ক্লাস শেষ করার সুবিধাও রয়েছে। টাকার বিনিময় ব্যতীত শিক্ষা; এই বাজারে এমন সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই জগৎ, সংসার, মহামারী- সব কিছু উপেক্ষা করে; মহা উৎসাহ নিয়ে ক্লাস শুরু করেছিলাম। কিন্তু সাধা জিনিসের দাম আধা। কোর্স শেষ করার ক্ষেত্রে আমার অবস্থাও ঠিক একই রকম।

তথ্যনির্দেশ

Indigenous Canada, Alberta University/Coursera.org