কচ্ছপ দ্বীপের উপাখ্যান

Reading Time: 4 minutes

কিন্তু গল্প বলা তো থেমে থাকতে পারে না; লিখিত ইতিহাসে যেইসব গল্প পাওয়া যায় না। কানাডার আদিবাসী মানুষেরা সেইসব গল্প বলা’কে তাদের জীবন যাপনের পথ নির্দেশনা বলে বিশ্বাস করতো। প্রধানত দুই ধরনের মৌখিক গল্পের প্রচলন ছিল। এক ধরনের গল্পে- ব্যাক্তির অভিজ্ঞতা, নির্দিষ্ট কোনো স্থানের নামকরণের কাহিনী, পর্যবেক্ষণ বা উপলদ্ধি মূলক বিবরণ পাওয়া যায়। এধরনের গল্পগুলো সময়ের সাথে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও প্রাসঙ্গিকতার বিচারে তা পরিবর্তিত হতে থাকে। সমাজের সকল স্তরেই এসব উপাখ্যানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। শিক্ষণীয় এসব গল্পের মাধ্যমে; নিজস্ব ইতিহাস ও পরিবেশ সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি তৈরী হতো। গল্প বলার প্রচলন; তাদের সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। দ্বিতীয় ধরনটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত যা সাধারনত সৃষ্টির গল্প, কিংবদন্তি বা পৌরাণিক গল্প হিসেবে পরিচিত। এইসব গল্পের আত্মিক দিকটি সময়ের সাথে অপরিবর্তিত থেকে যায়।

কচ্ছপ দ্বীপের গল্পকেও সৃষ্টির গল্প বলা যায়; যার কোনো লিখিত রূপ ছিল না। মৌখিকভাবে এ গল্প বলা হতো। গল্প শেষ করতে পুরো এক দিন কখনোই যথেষ্ঠ সময় ছিলো না। কখোনো গল্প শেষ করতে এক সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। আদিবাসী সম্প্রদায় ভেদে কচ্ছপ দ্বীপের গল্পে নানা রকম পরিবর্তন দেখা যায়। তবে বেশিরভাগ গল্পেই জীবন এবং পৃথিবীর রূপক হিসেবে কচ্ছপের ব্যবহার হয়েছে। আমাদের মূল লেখা নেহিয়াওয়াক জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত গল্প নিয়ে। প্রাসঙ্গিক আলোচনা হিসেবে ওজিবওয়ে এবং হডনেসোনী জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচলিত গল্পের সংস্করণ কিছুটা থাকবে।

Nehiyawak বা নেহিয়াওয়াক

নেহিয়াওয়াক শব্দের অর্থ যারা একই ভাষায় কথা বলে। সাধারনত নেহিয়াওয়াক বলতে ‘ক্রি’ জনগোষ্ঠীকে বোঝায়। তাদের কচ্ছপ দ্বীপের গল্প শুরু হয় ‘কায়াস’ শব্দটি দিয়ে, বাংলায় যার অর্থ- অনেক দিন আগে। মূল গল্পের ভাবানুবাদ- অনেক দিন আগের কথা; তখন কচ্ছপ দ্বীপের বুকে হামাগুড়ি দেয়া, হেঁটে চলা, উড়ে বেড়ানো এবং বুকে ভর দিয়ে চলা সকল প্রাণী শান্তিপূর্ণভাবে একসাথে বসবাস করত। যারা সাঁতার কাটে তারা সাগরের গভরি নীল জলরাশিতে সাঁতার কেটে বেড়াত। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। সৃষ্টিকর্তাও সৃষ্টির মাঝে এমন ঐক্যতান দেখে হাসলেন।

এরপর গল্পে আগমন ঘটে (Wee-sak-ee-jack) উইস্যাকইজ্যাক নামক রহস্যময় চরিত্রের। ধারনা করা হয় নেহিয়াওয়াক জনপদের মাঝে যতগুলো গল্প প্রচলিত রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশী গল্প যার সম্পর্কে, সে এই উইস্যাকইজ্যাক। তার কোন লিঙ্গভেদ নেই। গল্পে মাঝে প্রায়ই; তার ধূর্ততা ও কৌশলের কারণে তাকে সমস্যায় পড়তে দেখা যায়। তবে সে ছিল ভীষণ অলস। সৃষ্টিকর্তা তাকে প্রত্যেক প্রাণীর দেখভাল করার ও তাদের যত্ন নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার অলসতার কারণে সে তার দায়িত্বে অবহেলা করতে থাকে। একসময় সকল প্রাণীর মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির মধ্যেকার  পুরোনো সেই ঐক্যতান ধীরে ধীরে বিনষ্ট হয়। কচ্ছপ দ্বীপের প্রাণীরা একে অপরকে অসম্মান করতে শুরু করে। তারা মারামারি ও হত্যাযজ্ঞে লিপ্ত হয়। একে অপরের সাথে লড়াইয়ের মাত্রা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে কচ্ছপ দ্বীপ রক্তে লাল হয়ে যায়।

স্রষ্টা ভীষণ ক্ষু্দ্ধ হলেন। তিনি উইস্যাকইজ্যাক কে সতর্কবার্তা পাঠালেন যে, অবিলম্বে কচ্ছপ দ্বীপের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা চাই; স্রষ্টার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করা চাই। অন্যথায় উইস্যাকইজ্যাক- এর সকল ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হবে। পাশাপাশি জমি, বন, পাহাড় সবকিছু কেড়ে নেয়া হবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার এসব কথা সে মোটেই বিশ্বাস করলো না। অন্যদিকে একে অপরের সাথে লড়াইয়ের মাত্রা এতটাই প্রবল হয়ে ওঠে যে কচ্ছপ দ্বীপ রক্তে লাল হয়ে যায়।

সৃষ্টিকর্তা সবকিছু কেড়ে নিয়ে, নতুন করে সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কচ্ছপ দ্বীপের মাটি থেকে রক্তের দাগ মুছে দিতে ও সবকিছু ধুয়ে দিতে প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হলো। প্রবল বর্ষণের কারণে বন্যা পানি তেড়ে আসতে থাকল। বন্যা অবশ্য সাাঁতার কাটা প্রাণীদের কোনো ক্ষতি করলো না। জলের প্রকোপে, অন্য সব প্রাণী ডুবে গেল। কানায় কানায় জলে পরিপূর্ণ পৃথিবীতে চারজন মাত্র বেঁচে রইল।

উইস্যাকইজ্যাক, ধারালো দাঁতওয়ালা লোমশ বীভার (Beaver), অটার (Otter) বা জলনকুল ও মাস্ক্রাট (Muskrat)। (সবগুলো প্রাণীর বাংলা নাম জানা নেই। কারো জানা থাকলে সাহায্য করতে পারেন) এরা সবাই সমুদ্রের মাঝখানে একটি বড় গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে ভেসে রইল। অসহায় উইস্যাকইজ্যাক তার মূর্খতা এবং অলসতার কথা ভেবে কান্না করতে শুরু করলো। সেই সব হারিয়ে যাওয়া জীবনের কথা ভেবে সে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। বীভার, অটার ও মাস্ক্রাট; তার এ দুরবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা করলো- আমরা কিভাবে সাহায্য করতে পারি? তাদের স্নেহশীলতায়, উইস্যাকইজ্যাক পুনরায় সাহস ফিরে পেলো। সে ভাবলো যে; জলের নীচে হারিয়ে যাওয়া পুরোনো পৃথিবীর মাটির সামান্য অংশ যদি পাওয়া যায়, তাহলে তার অবশিষ্ট ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বসবাস করার জন্য হয়তো একটি ছোট্ট দ্বীপ তৈরি করা যাবে। সৌভাগবশত বীভার, অটার ও মাস্ক্রাট; এরা তিনজনই ছিল অবিশ্বাস্য রকমের ভালো সাঁতারু। উইস্যাকইজ্যাক প্রথমে অটার এর কাছে সাহায্য চাইলো- অতল সমুদ্রের গভীরে ডুব দিয়ে; হারিয়ে যাওয়া পৃথিবী থেকে মাটির সামান্য অংশ তুলে আনতে হবে। অটার ডুব দিয়ে জলের গভীরে হারিয়ে গেলো। কিন্তু অটার দম ফুরিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে খালি হাতে ফিরে এলো। উইস্যাকইজ্যাক এবার বীভারের কাছে সাহায্য চাইলো। সাঁতার কাটতে সহায়ক; চ্যাপ্টা আর শক্তিশালী লেজ ছিল বীভারের কাছে। বীভার জলের গভীরে ডুব দিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য হারিয়ে গেলো। শূন্যহাতে যখন সে ফিরে এলো, তখন তার প্রায় প্রাণহীন শরীর। আশাহত উইস্যাকইজ্যাক এবার পুরোপুরি ভেঙ্গে পরলো। এবার মাস্ক্রাট নিজে থেকেই বললো- আমি যাবো। তার কথা শুনে অটার ও বীভার উন্মাদের মতো হাসতে থাকলো। কারণ মাস্ক্রাট; আকারে তাদের দুইজনের তুলনায় নিতান্তই ছোটখাটো।

উইস্যাকইজ্যাক এবার মাস্ক্রাট কে তুলে নিয়ে বললো- তুমি সত্যিই কি পারবে? মাস্ক্রাট সোজাসাপ্টা জবাব দিলো- দেখ আমি কি করতে পারি। বলেই সে ডুব দিলো। প্রথমবার অবশ্য সে খালি হাতে ফিরে এলো। দ্বিতীয়বার যখন সে তার প্রায় প্রাণহীন শরীরটা নিয়ে ফিরে এলো; তখন তার হাতের মুঠির ভেতরে উইস্যাকইজ্যাক পেলো খুব সামান্য পরিমাণ মাটির কণা। তৎক্ষণাত তার অবশিষ্ট ঐশ্বরিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে উইস্যাকইজ্যাক মাটির কণার উপর ফুৎকার দিলো। নিমিষেই এক বিন্দু মাটির কণা প্রসারিত হতে হতে একটি দ্বীপ তৈরি হলো।

Coursera.org ওয়েবসাইটে Indigenous Canada নামক কোর্সটি নামমাত্র মূল্যে সনদপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আবার বিনামূল্যে ক্লাস শেষ করার সুবিধাও রয়েছে। টাকার বিনিময় ব্যতীত শিক্ষা; এই বাজারে এমন সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই জগৎ, সংসার, মহামারী- সব কিছু উপেক্ষা করে; মহা উৎসাহ নিয়ে ক্লাস শুরু করেছিলাম। কিন্তু সাধা জিনিসের দাম আধা। কোর্স শেষ করার ক্ষেত্রে আমার অবস্থাও ঠিক একই রকম।

তথ্যনির্দেশ

Indigenous Canada, Alberta University/Coursera.org