জুয়াড়ির গান: ঋগ্বেদের মানুষ
জুয়াড়ির গান, ঋগ্বেদের একটি শ্লোক। ঋগ্বেদ হচ্ছে ধর্মীয় আচার, অনুশাসনের সংকলন। দেবতা ও ঋষিদের দার্শনিক দূরকল্পনা । তাদের পাশাপাশি টিকে যাওয়া একজন সাধারণ মানুষের গল্প পাওয়া যাবে ‘জুয়াড়ির গান’ শ্লোকে। লিপিবদ্ধ হবার অনেক আগে থেকেই শ্লোকগুলো প্রচলিত ছিল। শুধুমাত্র গুরু থেকে শিষ্যের কাছে মৌখিকভাবে তা প্রচার করা হত। জুয়াড়ির গান; তেমনি প্রচলিত একটি শ্লোক। পুরোহিতদের যজ্ঞের বিবরণের বাইরে নিতান্তই সাধারণ এক জুয়াড়ির কথা পাওয়া যাবে এ শ্লোকে।
জুয়াড়ির গান- মূল লেখাটি ঋগ্বেদ থেকে অনুবাদ করা হয়েছে । পাশার ঘুঁটি কিভাবে জুয়াড়ির হৃদয়কে ছাড়খাড় করে দেয় তার বিবরণ পাওয়া যাবে এ শ্লোকে ।
তারা হস্তহীন, তাদের সেবার কাজে মানুষকেই হাত লাগাতে হয় ।
ঋগ্বেদ দশম, ৩৪ । সংকলন ১.৪ । বৈদিক সভ্যতা; ইরফান হাবিব ।
ছকের ওপর ঢালাই করা, যাদু কাঠ কয়লার মতো, যদিও তারা নিজেরা শীতল, তবু তারা হৃদয়কে পুড়িয়ে ছাই করে দেয় ।
ঋগ্বেদে সৃষ্টি সম্পর্কিত যে শ্লোক রয়েছে তার সাথেও এর পার্থক্য এখানেই । এখানে জুয়াড়ির স্বভাব, নিঃসঙ্গতা আলোচনার প্রধান বিষয় । জুয়াড়ির গান- তখনকার সামাজিক অবস্থান সম্পর্কেও সাধারণ বিবরণ তুলে ধরে। শ্লোকটি নিম্নরূপ –
জুয়াড়ির গান
আমার প্রাণাধিক প্রিয় পাশার ঘুঁটি, মুদ্রাভানের আপন
সুরার গাঢ় খরার চেয়েও কোনোদিন সে নিদ্রালস হয় না ।
সে কখনো আমাকে বিরক্ত করে না, কিংবা আমার ওপর রাগ করে না,
বরং আমার বন্ধুদের ওপর, আমার ওপর কৃপা বর্ষণ করে ।
আমার পাশার ঘুটিঁর কারণে, যার একটি বিন্দুই চূড়ান্ত,
তার জন্যে আমার অনুগতা স্ত্রীকে ছেড়ে এসেছি আমি ।
আমার স্ত্রী আমাকে একলা ধরে রেখেছে, তার মা আমাকে ঘৃণা করে;
হতচ্ছাড়া মানুষটি তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য কাউকে খুঁজে পায় না ।
মহামূল্যবান ঘোড়া যখন বৃদ্ধ আর দুর্বল হয়ে যায় তখন যেমন সে মূল্যহীন
তেমনি জুয়ায় আমি কোনো লাভের মুখ দেখি না ।
জুয়াড়ি যখন কোনো পরিচারিকাকে দেখে, দেখে অন্যের স্ত্রীকে, কারোর সুশৃঙ্খল গৃহস্থালী, সে বিষণ্ণ হয় ।
খুব ভোরে সে তার বাদামী ঘোড়া জোয়ালে জুতে নেয় এবং যখন আগুন ঠাণ্ডা হয়ে যায়, তখন সে পরিত্যক্ত অবস্থায় ডুবে যায় ।
ঋগ্বেদ দশম, ৩৪ । সংকলন ১.৪ । বৈদিক সভ্যতা; ইরফান হাবিব । পৃ:৩৩। অনুবাদ: বিজয় কুমার ঠাকুর ।
বৈদিক সভ্যতা ও ঋগ্বেদ
ঋগ্বেদ সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম সাহিত্যিক সুত্র । শুরুতে এর কোনো লিখিত রূপ ছিল না । প্রাচীনকালে ঋষি, মুনিরা গুরু হতে শিষ্যের কাছে মৌখিকভাবে এ শিক্ষা পৌছে দিতেন । ঋষি বা পুরোহিতদের কাছে যা ছিল অত্যন্ত পবিত্র । বলা হয় এর প্রতিটি পঙক্তি সম্পর্কে ঋষিরা শ্রুত অথবা দৃষ্ট হয়েছেন । তাই ঋগ্বেদ শ্রুতি সাহিত্যের অন্তর্ভূক্ত । ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব- চারটি বেদের প্রথমটির নাম ঋগ্বেদ সংহিতা। বেদের প্রাথমিক পাঠ বা সংকলনকে সংহিতা বলে । প্রতিটি সংহিতার সাথে যুক্ত থাকে একটি ব্রাহ্মণ । যা মূলত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনের নির্দেশনা সংকলন । প্রতিটি ব্রাহ্মণে একটি আরণ্যক ও একটি উপনিষদ থাকে ।
জুয়াড়ির গান- ঋগ্বেদ
পুণ্ড্রনগর গড়ে তোলা ‘পুণ্ড্র’ জাতির উল্লেখ পাওয়া যায় এমন একটি সংহিতার নাম ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’ । এ সম্পর্কে ‘হারানো নদী হারানো জনপদ’ লেখাটিতে সংক্ষিপ্ত বিবরণ রয়েছে । তাছাড়া ‘বঙ্গ’ জাতির সর্বপ্রথম উল্লেখ করা হয়েছে ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ সংহিতায় । এছাড়াও রয়েছে স্মৃতি সাহিত্য । স্মৃতি শব্দের সাথে ‘স্মর’ এর সম্পর্ক রয়েছে; যার অর্থ স্মৃতিচারণ করা । মহাভারত, রামায়ণ, অর্থশাস্ত্র, বিভিন্ন পুরাণ ইত্যাদি স্মৃতি সাহিত্যের অন্তর্গত । তবে পুরাণ অনুযায়ী, ‘স্মৃতি’ হচ্ছে দেবতা ধর্ম ও মেধা’র মেয়ে । স্মৃতি; নির্দিষ্ট লিপিকর দ্বারা রচিত । স্মৃতিকে সাধারণত মৌলিক কাজ হিসেবে ধরা হয় না এবং শ্রুতির তুলনায় কম নির্ভরযোগ্য বলে মনে করা হয় । ধর্মীয় আচার, অরণ্যবাসী ঋষিদের জন্য উপদেশ ও দার্শনিক নির্দেশনার মাঝে জুয়াড়ির গান- শ্লোকটি নিসন্দেহে একটি অনবদ্য শিল্পকর্ম ।
তথ্যনির্দেশ
বৈদিক সভ্যতা; ইরফান হাবিব । পৃ:৩৩। অনুবাদ: বিজয় কুমার ঠাকুর ।
ঋগ্বেদ দশম, ৩৪ । সংকলন ১.৪ । (গ্রিফিতের অনুবাদ, সামান্য পরিবর্দ্ধিত)
শ্রুতি শব্দটিকে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়, বিশেষ করে ছান্দোগ্যোপনিষদ্ এর ৭.১৩ অনুচ্ছেদে । স্মৃতি সাহিত্য হচ্ছে বিভিন্ন গ্রন্থের সংকলন । মহাভারত ও রামায়ণ, ধর্মসূত্র এবং ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র, বিভিন্ন পুরাণ, কাব্য ইত্যাদি ।
জুয়াড়ির গান by নির্ঝর মাহমুদ is licensed under CC BY-NC-SA 4.0