মানুষের ইতিহাসের সাথে জুড়ে আছে লুটপাটের ইতিহাস। যে কোনো যুদ্ধের ইতিহাসে; লুটপাট একটি সাধারণ উপজাত হিসেবে সবসময় উপস্থিত ছিল। প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের মিশর আক্রমণের কথা আমাদের সবার জানা। তিনি তার চারশত জাহাজে সৈনিক ও নাবিকের পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক, প্রকৌশলী ও অজস্র পণ্ডিতদের নিয়ে আসেন। তাদের কাজ ছিল মিশরের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক উপাদান লুট করা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘রোসেটা স্টোন’, পাথরে খোদাইকৃত একটি রাজকীয় ফরমান। এই ‘রোসেটা স্টোন’ মিশরীয় হায়রোগ্লিফের অর্থ পুনোরুদ্ধারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। যা পরবর্তীতে ফরাসীদের হাতে চলে আসে।
তাই বলা যায়, প্রত্নতত্ত্ব চর্চার সাথে ‘লুট’ শব্দটির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তৎসম বা সংস্কৃত √লুট্ থেকে ‘লুট’ শব্দটির উৎপত্তি। ইংরেজি ‘Loot’ বা ‘Looting’ শব্দের উৎপত্তিও এই সংস্কৃত শব্দ থেকে।
জাদুঘরে সংরক্ষিত অধিকাংশ পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হয় লুটেরাদের কাছ থেকে কেনা অথবা সংগৃহীত।
ন্যান্সি ম্যারী হোয়াইট
এক্ষেত্রে জিওভানী বেলজনীর কথা বলতেই হয়। তিনি ছিলেন সার্কাসের আয়োজক । পুরাকীর্তি, প্রত্নবস্তুর চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি পেশা বদল করে পুরাতত্ত্ব সংগ্রহ করতে থাকেন। ১৮১৭-১৮২০ সাল পর্যন্ত তার লুটপাটে মিশরের বহু স্থাপনা ধুলায় মিশে যায়। তিনি ২য় রামসেস এর ভাস্কর্য লণ্ডনে পাঠান যা এখনো লণ্ডন জাদুঘরে রয়েছে।
একই কারণে, প্রাথমিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান বা খনন কাজগুলো; প্রাচীন কোনো স্থাপনাকে কেন্দ্র করে অথবা প্রদর্শন মূল্য রয়েছে এমন বস্তু বা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের উদ্দেশে পরিচালিত হতো। শুধুমাত্র লুটপাটের কারণে, প্রাচীন যে কোন সমাধি বা প্রাগৈতিহাসিক স্থান অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায় না।
১৮৪০ সাল পর্যন্ত প্রত্নতত্ত্ব, ধনী ও হঠকারী সংগ্রাহকদের শখের পেশা হিসেবে বিবেচিত হতো। অপেশাদার ইতিহাসবিদ, ভূতাত্ত্বিকদের কাছে তা ছিল যে কোন আকর্ষণীয় বস্তু সংগ্রহের প্রক্রিয়া মাত্র। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব প্রত্নবস্তু কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে তার কোন লিখিত সুত্র বা উৎস পাওয়া যায় নি
মার্থা জুকোস্কি
প্রত্নবস্তু পুনর্ব্যবহারের কারণে অনেক সময় সাধারন মানুষকে দায়ী করা হয়। কিন্তু মানুষ হাজার বছর ধরে বিভিন্ন প্রত্নবস্তু পুনর্ব্যবহার করে আসছে। তাছাড়া মানুষের জীবন জীবিকা স্থান কাল নিরপেক্ষ নয়। তাই কখনও কখনও দেখা যায় একজন শ্রমিক বা কৃষক চাষাবাদের সময় খুঁজে পাওয়া কোনো পাত্র বা প্রত্নবস্তু বিক্রি করে দেয়। যেমন- ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে উয়ারী গ্রামে মাটি খননকালে শ্রমিকেরা একটি মৃৎপাত্রে সঞ্চিত কিছু রৌপ্যমুদ্রা পান। যার অধিকাংশই তাঁরা স্থানীয় বেনেদের কাছে বিক্রি করে দেন। বন্ধু ম্যাথিউর সাথে আড্ডায় এমন একটি গল্প পাওয়া যায়। আট বছর আগে পেরু ভ্রমণকালে স্থানীয় একটি বাজার থেকে কেনা মাটির পাত্র নিয়ে এই গল্প। প্রাথমিক পরীক্ষা থেকে জানা যায় পাত্রটি চিমু সভ্যতার সাথে সম্পর্কিত।
সাধারন মানুষের মাঝে সংরক্ষণের প্রবণতাই বেশী। যেমন- উয়ারী-বটেশ্বরে মোহাম্মাদ হানীফ পাঠান শ্রমিকদের কাছ থেকে ২০-৩০টি মুদ্রা সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। তখন থেকেই উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের সূচনা।
একই রকম গল্প পাওয়া যায় চীনের কৃষকেদের মাঝে। তারা কূপ খননের সময় কতগুলো পোড়ামাটির মূর্তি আবিষ্কার করেন; মাটির নীচে, সমাধির প্রশস্ত পথ দেখতে পান। পরবর্তীতে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে জানা যায় এ সমাধি প্রায় ২০০০ বছর পুরোনো; ২৪৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দে সম্রাট চিন শি ওয়াং- এর সময়কালের।
ক্রেতা, সংগ্রাহক ও ব্যবসায়ীরাই সাধারনত আন্তর্জাাতিক বাজারের নিয়ন্ত্রক। তারা নিলামের উদ্দেশ্যে প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন পাচার করে অথবা বিক্রি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। সাম্প্রতিক একটি ঘটনা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ২০১৮ সালের নভেম্বরে, ডার্বির হ্যানসন নামক একটি নিলামকারী প্রতিষ্ঠানে খুঁজে পাওয়া যায় ১৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের একটি মৃৎপাত্র। বছর খানেক আগে, মার্টিন নামক একজন কর্মচারী মাত্র ৪ ইউরোতে যা কিনেছিলো। একই প্রতিষ্ঠানের পুরাকীর্তি বিশেষজ্ঞ জেমস ব্রেঞ্চলি পরবর্তীতে নিশ্চিত করেন মৃৎপাত্রটি প্রায় ৪০০০ বছর পুরোনো। এর কারিগর সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার মানুষ।
এখনও প্রাচীন সভ্যতার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান লুট হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক শিক্ষা ও সচেতনতা অবশ্যই সমাধান। মানুষকে বুঝতে হবে যে, লুটপাটের মাধ্যমে একটি জাতির প্রাচীন বংশধারার মুছে ফেলার পাশাপাশি তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিনষ্ট করা হয়। কিন্তু যুদ্ধ ও লুটপাট যে মানবতার জন্য অপরাধ তা উপলব্ধি করা সহজ নয়।
তাই প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের ব্যপারে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি; অনেক তথ্য অনুপস্থিত থাকা সত্বেও তারা প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে অতীতের ঘটনাগুলো ব্যাখ্য করার চেষ্টা করেন।
তথ্যসূত্র
Archaeology for Dummies; Page: 28, 238, 279.
উয়ারী-বটেশ্বর : শেকড়ের সন্ধানে, পৃষ্ঠা: ২৩।
Image credit: https://ancientart.as.ua.edu/looting-the-ancient-middle-east/
সিন্ধু সভ্যতার মৃৎপাত্র। Indus Valley Pottery By Hansons Actioneers
This work is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-ShareAlike 4.0 International License.