সাকাশ্বর স্তম্ভ

Reading Time: 4 minutes

পাথরের প্রতীকী অর্থ

স্তম্ভ বা পাথরকে পবিত্র ভেবে উপাসনা করা আদিকাল থেকে পরিচিত এবং বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মে এ প্রচলন দেখা যায়। প্রায়শই এগুলি বিভিন্ন জাদুকরী অনুষ্ঠানের উপাদান বা ভবিষ্যদ্বাণীর মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া সীমানা পাথর বা স্মারক হিসাবেও ব্যবহার করা হয়। এই স্তম্ভ অদেখা শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে বলে বিশ্বাস স্থাপনের কারণে, মানুষ বারবার এর কাছে ফিরে আসে। কেল্টিক (Celtic) উৎসে এধরনের পাথরকে বলা হয় মেনহির (Menhir)।

এমন পাথরের প্রতীকী অর্থ নির্ধারণ করা সহজ কাজ নয়। স্থানভেদে এমন পাথরকে মানুষ দৃঢ়তা, বন্ধ্যাত্ব বা উর্বরতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত করতে পারে।

সাকাশ্বর স্তম্ভ, সাকাশ্বর, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।
চিত্র সংগ্রহ- শ্যাম বর্ণ। মৃত্তিকা।

This work is licensed under a Creative Commons Attribution 4.0 International License.

সাকাশ্বর স্তম্ভটি কোথায় অবস্থিত?

বংশাই নদীর পাড়ে অবস্থিত গ্রামের নাম সাকাশ্বর। এ নদীর পাড় ঘেঁষে একটি মন্দির দেখা যায়। স্থানীয় ভাবে পরিচিত এ মাধব মন্দিরেই সাকাশ্বর স্তম্ভটি অবস্থিত।

মানচিত্রে এর অবস্থান: 24°03’23.9″N 90°20’02.6″E

জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে চন্দ্রা চৌরাস্তার মাঝে, অর্থাৎ গাজীপুর থেকে টাঙ্গাইল রুটের কোনাবাড়ি বাস ষ্ট্যান্ড থেকে একটা শাখা রাস্তা চলে গেছে উত্তর দিকে। এ পথেই সাকাশ্বর গ্রাম। টেম্পু ও সিএনজি অটোরিক্সা পাওয়া যায়। জনপ্রতি ২০ টাকা ভাড়ায় সাকাশ্বর বাজার চার রাস্তার মোড়ে পৌছানো সম্ভব (বর্তমান ভাড়ায় তারতম্য থাকতে পারে)। কোনাবাড়ি ষ্ট্যান্ড থেকে সময় লাগবে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। (দেশ আমার থেকে সংগৃহীত)

‘সাকাশ্বর’ নামের অর্থ কী?

স্থানীয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শ্রদ্ধা ও উপাসনার অবলম্বন সাকাশ্বর স্তম্ভ। অনেক স্থানে ‘শাকাসর’ নামটিও পাওয়া যায়। ‘সাকাশ্বর’ বা ‘শাকাসর’ নামটি কীভাবে এলো তা সম্পর্কে জানা যায় না? তবে আমরা জানি; ‘সাকার’ অর্থ আকারযুক্ত, মূর্ত, অবয়ববিশিষ্ট, দেহধারী, বস্তুগত। সাকারবাদ; ঈশ্বরের মূর্তি আছে এই মত। তাই সাকাশ্বর অর্থ হতে পারে, যে ঈশ্বরের আকার রয়েছে।

সাকাশ্বর স্তম্ভের বিবরণ

সাকাশ্বর স্তম্ভের উচ্চতা প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার ফুট । এটি কি ধরণের বা পাথরের প্রকৃতি কি তা জানা যায় না। তবে ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের উপরের অংশে অষ্পষ্ট ভাবে খোদাইকৃত মূর্তির প্রতিকৃতি বোঝা যায়।

সাকাশ্বর স্তম্ভ, সাকাশ্বর, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।
চিত্র সংগ্রহ- শ্যাম বর্ণ। মৃত্তিকা।

This work is licensed under a Creative Commons Attribution 4.0 International License.

সাকাশ্বর ও প্রত্যাদেশ

সাকাশ্বর স্তম্ভ নিয়ে আমরা যতটুকু জানি তার থেকে না জানা প্রশ্নের সংখ্যাই বেশী। স্তম্ভটি কোথা থেকে এলো? মানুষ সাকাশ্বর স্তম্ভের সাথে কী সম্পর্ক খুঁজে পায়? মাধব মন্দিরের সাথে এই সাকাশ্বর স্তম্ভের কী সম্পর্ক? সাকাশ্বর স্তম্ভের সাথে দৈববাণী বা প্রত্যাদেশের কী সম্পর্ক? সাকাশ্বর স্তম্ভকে অশোক স্তম্ভ বলার কারণ কী?

এই স্তম্ভকে ঘিরে প্রচলিত রয়েছে প্রত্যাদেশ সম্পর্কিত একটি গল্প। বর্তমানে স্তম্ভটি যে স্থানে আছে, পূর্বে তা অন্যকোথাও ছিল বলে জানা যায়। জনশ্রুতি আছে, কেউ একজন সাকাশ্বর স্তম্ভটি তুলে নদীতে ফেলে দেয়। তার কিছুদিন পর সে স্বপ্নে দেখতে পায় যে, যদি নদী থেকে স্তম্ভটি না উদ্ধার করা হয়, তাহলে তার ক্ষতি হবে। বহু লোকজন দিয়ে নদী থেকে তুলে স্তম্ভটি পুনস্থাপন করা হয়। সাকাশ্বর স্তম্ভের সাথে এই দৈববাণী বা প্রত্যাদেশের কী সম্পর্ক থাকতে পারে?

প্রচলিত গল্পটির মাঝেই এর উত্তর পাওয়া যায়। মানুষ সবসময় তার প্রশ্নের জন্য একটি সন্তোষজনক ব্যাখ্যা খুঁজতে থাকে। এ কারণেই মানুষ Oracle বা প্রত্যাদেশ অথবা দৈববাণীর কাছে আশ্রয় নেয়। সাকাশ্বর স্তম্ভকে নিয়ে সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে মানুষ হয়তো দৈববাণীর কাছে

সাকাশ্বর স্তম্ভকে অশোক স্তম্ভ বলার কারণ কী?

সাকাশ্বর স্তম্ভকে ঘিরে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন সম্ভবত এটাই যে, স্তম্ভটি আসলেই সম্রাট অশোক নির্মিত কিনা?

খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩-২৭২ সময়কালের মাঝে বিন্দুসারের মৃত্যু ঘটে। বিন্দুসারের পর সিংহাসনে কে বসবে তা নিয়ে পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার রক্ষার লড়াই শুরু হয়। এ লড়াই চার বছর স্থায়ী হয়েছিল। ২৬৯-২৬৮ খ্রিস্টপূর্বে অশোক বিন্দুসারের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচিত হন। সম্রাট অশোক তার রাজত্বকালে যে শিলালিপি প্রচার করেন তার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হিসেবে পাথরের স্তম্ভে, বড় পাথরখণ্ড বা গুহার দেয়ালে বেশ কিছু নমুনা পাওয়া গেছে। সেইসব প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে অশোক স্তম্ভ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব। সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে  ব্রাহ্মী, খরোষ্ঠী, গ্রীক ও আরামিক ভাষার ব্যবহার দেখা যায়। তাছাড়া স্তম্ভের ওপর সিংহ বা হাতির মূর্তির ব্যবহার দেখা যায়। রামাপূর্বা নামক স্থানে ষাঁড়ের মূর্তিযুক্ত স্তম্ভও পাওয়া গেছে। কান্দাহার ও কর্ণাটকে শুধুমাত্র বড় পাথরের গায়ে অশোকলিপির প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই শুধুমাত্র পাথরের স্তম্ভ থেকে বলে দেয়া মুশকিল যে সাকাশ্বর স্তম্ভটি অশোক স্তম্ভ।

তবে ধামরাই এর বংশাই নদী তীরে প্রাচীনকালে জনবসতি ছিল তা অনুমান করা যায়। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার ‘বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইতে ধামরাই প্রসঙ্গে বলেন-

‘সাভারের উত্তর-পশ্চিমে বংশাই নদীর ডানতীরে এবং নয়ারহাট ব্রীজের পশ্চিম-উত্তরে ধামরাই নামক একটি প্রাচীন স্থান আছে। বৌদ্ধ ‘ধর্মরাজিকা’ শব্দ থেকে ধামরাই নামের উৎপত্তি বলে অনেকে অনুমান করেন। আবার কেউ কেউ বলেন যে, দামো ঘোষের ‘দামো’ ও তার স্ত্রী ‘রাই’- এর নাম থেকে দামোরাই এবং তা থেকে ধামরাই নামের উৎপত্তি। তবে এস্থানে যে বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্র ছিল, তাতে বোধ হয় কোনো সন্দেহ নেই। পরে এখানে হিন্দু ও মুসলিম ধর্মকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।

এখানে হাজী-গাযীর মাযার প্রাঙ্গনের তোরণের দু’পাশে প্রায় এক মিটার উঁচু ও গ্রানাইট পাথরে তৈরি দুটি প্রস্তরস্তম্ভের অবস্থান নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, এখানে অন্তত গুপ্ত যুগেরও আগে এমন একটি প্রতিষ্ঠান ছিল যার তোরণটি নির্মিত হয়েছিল গ্রানাইট পাথর দিয়ে।’

বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, পৃষ্ঠা: ৫১৩। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া।

ধামরাই এর বংশাই নদী তীরে প্রাচীন জনবসতি সম্পর্কে আরো জানা যায় শ্রীযোতীন্দ্রমোহন রায় রচিত ঢাকার ইতিহাস (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থ থেকে।

‘পূর্বে এ অঞ্চলটি ‘মাধববাড়ীরঘাট’ হিসেবে পরিচিত ছিল। একসময় এখানে ‘বনদুর্গা’ পূজার প্রচলন ছিল। তাছাড়া লাকুরিয়াপাড়ার রাস্তা দিয়ে একসময় ‘ধামরাই রথ’ টানা হতো।’

ঢাকার ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)। শ্রীযোতীন্দ্রমোহন রায়।

তাই বলা যায়, শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমেই সাকাশ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত জানা সম্ভব। সাকাশ্বর সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা এ পর্যন্তই। আগ্রহী যে কেউ, সাকাশ্বরকে ঘিরে স্থানীয় গল্প অথবা যেকোন তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করতে পারেন। তার জন্য অগ্রীম ‍শুভেচ্ছা রইল।

তথ্যসূত্র

চিত্র সংগ্রহ- শ্যাম বর্ণ, মৃত্তিকা। সাকাশ্বর, কালিয়াকৈর, গাজীপুর।

Asoka and The Decline Of The Mauryas, Page: 19. Romila Thapar.

বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, পৃষ্ঠা: ৫১৩। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া।

ঢাকার ইতিহাস (প্রথম খণ্ড); পৃষ্ঠা: ৩১৪-৩১৫, শ্রীযোতীন্দ্রমোহন রায়।


This work is licensed under a Creative Commons Attribution 4.0 International License.

Recommended Posts

No comment yet, add your voice below!


Add a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *